সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন?

সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন?
MostPlay

বাংলাদেশে সিন্ডিকেট, বিশেষ করে বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে কয়েকদিন পর পরই হইচই হয় ৷ তারাই বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ ৷ সরকারের দিক থেকেও এই সিন্ডিকেটের কথা বলা হয় ৷ কিন্তু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন? সম্প্রতি ডিম সিন্ডিকেট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে ৷ এর আগে ভোজ্যতেল, চাল, পেঁয়াজ এমনকি আলুর সিন্ডিকেট নিয়েও ব্যাপক হইচই হয়েছে ৷

সিন্ডিকেটের অভিযোগে ভোক্তা অধিদপ্তর থেকে চিঠি দিয়ে ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের ডেকে কথাও বলা হয়েছে ৷ কিন্তু তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি ৷ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে কথা বলে জানা গেছে সিন্ডিকেটের মূল কাজ হলো সরবরাহ ব্যবস্থায় বাধা দেওয়া ৷ এটা করতে গিয়ে তারা পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দেন এবং পণ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেন ৷ মূল কথা হলো বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও চাহিদার স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বাধাগ্রস্ত করা ৷ বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমিয়ে দিলেই দাম বেড়ে যায় ৷

তবে এটা করতে হলে বাজারের বড় একটি অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয় ৷ এটা আমদানি পণ্য এবং দেশি বিশেষ ধরনের পণ্য যা অল্প কিছু ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে থাকে তাদের পক্ষে করা সহজ ৷ বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের ৯০ ভাগই আমদানি করা হয় এবং ছয়-সাতটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এই আমদানির সঙ্গে যুক্ত ৷ চাল নিয়ন্ত্রণ করেন কর্পোরেট ব্যবসায়ী ও চাতাল মালিকরা ৷ তারাও সংখ্যায় বেশি নয় ৷ আবার পেঁয়াজ দেশে উৎপাদন হলেও একটি অংশ আমদানি করতে হয় ৷ এই আমদানিকারকরাও সংখ্যায় বেশি নয় ৷

কিন্তু প্রশ্ন হলো গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে যে ডিমের দাম হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল তার নেপথ্যে কী? ডিম তো আমদানি করা হয় না ৷ আর বাংলাদেশে তো অনেক খামারি আছে ৷ বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, আমরা তো ক্ষুদ্র খামারি কিন্তু বাংলাদেশে ১০-১২টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আছে যারা মূল বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ৷ তারাই প্রতিদিন সকালে ডিম, মুরগির দাম বেঁধে দেয় ৷ তারা যে দাম বেঁধে দেবে সেই দামে বিক্রি করতে হবে ৷

দুই সপ্তাহ আগে তারা এভাবে সিন্ডিকেট করে ৫১৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ৷ তার কথায়, কোনো অজুহাত পেলেই তারা এই কাজটি করে ৷ এভাবে তারা বিভিন্ন সময় কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমার ধারণা বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ৷ এতে আমাদের মত খামারিদের কোনো লাভ হয় না ৷ ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান লাভবান হয় ৷ গত মার্চে ভোজ্যতেলের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ৷ পেঁয়াজ ও চালের বাজার নিয়েও একই অভিযোগ ৷ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, সিন্ডিকেটগুলো ভোগ্যপণ্যের সব খাতেই সক্রিয় ৷

আর এখন সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে টেলি এবং অনলাইন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো সহজ ৷ সারাদেশে একই সময়ে দাম বেড়ে যায় ৷ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে সেই বাড়তি দামের পেঁয়াজ দেশে আসার আগেই দাম বেড়ে যায় ৷ আমদানিকারক হাতে গোনা ৷ তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেন ৷ আর পেঁয়াজ আসার আগে পুরনো পেঁয়াজের সরবরাহও কমিয়ে দেন নতুন দামে বেচার জন্য ৷

তিনি আরো বলেন, চালের বাজার এখন চাতাল মালিক ছাড়াও কর্পোরেট গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় ৷ তবে তারা বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ চাল কিনে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করে ৷ তারই সুযোগ বুঝে সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়ে বিপুল মুনাফা করেন ৷ সরকার যে ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের চাপের মুখে ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে সাত টাকা বাড়াল, বাস্তবে এটা বাড়ানোর দরকার ছিলো না ৷

কারাণ চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে এখনো তেলের দাম কম ৷ তার কথায়, এখন ভোগ্যপণ্যের সব ধরনের ব্যবসা, আমদানি কর্পোরেট গ্রুপের হাতে ৷ এখানে প্রভাবশালীরা জড়িত ৷ কোনো কোনো ব্যবসায় সরকারের মন্ত্রীরাও আছে ৷ ফলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না বা ব্যবস্থা নেয় না ৷ কিন্তু দেশে সিন্ডিকেট ও মজুতের বিরুদ্ধে আইন আছে, তবে তা প্রয়োগ করা হয় না ৷  সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনেই মজুতদারি, সিন্ডিকেট, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় ৷

এই আইনে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের বিধান আছে ৷ তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? সরকারেই তো বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন ৷ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী তো সরাসরি ব্যবসা করেন ৷ আর যারা সরকারে নেই তারাও সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম ৷ তাই সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে না ৷ সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয় ৷ ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ডিম নিয়ে যারা সিন্ডিকেট করেছে আমরা তাদের ডেকেছি ৷ তাদের নিয়ে কাজ হচ্ছে ৷

অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দেখতে পাবেন ৷ আর ভোজ্যতেল নিয়ে যারা সিন্ডিকেট করেছে তাদের তথ্য আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি ৷ আটটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৷ তবে তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই তো কর্পোরেট কালচার আছে ৷ আমাদের এখানে ভোজ্যতেলের রিফাইনারি আছে আট থেকে ১০টি ৷ তাদের একটি হয়তো বাজারের ২০ ভাগ সরবরাহ করে ৷ এখন আমরা যদি মামলা করে তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেই তাহলে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে ৷

তাই আমরা চেষ্টা করি আইনের মধ্যে থেকে সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে ৷ আমরা অভিযান চালাচ্ছি, জরিমানা করছি ৷ কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অধিদপ্তরকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা ও এক বছরের কারাদণ্ডের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ৷ ভোক্তা অধিদপ্তর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করতে পারে না ৷ এটা জেলা প্রশাসক বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োগ করতে পারে ৷ কিন্তু ওই আইন প্রয়োগের তেমন নজির নেই ৷

সৌজন্যে : ডয়চে ভেলে

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password