কর্মজীবন ও জীবিকা এর মধ্যে পার্থক্য কী ?

  কর্মজীবন ও জীবিকা এর মধ্যে পার্থক্য কী ?
MostPlay

আমাদের পেশা সংক্রান্ত ধ্যানধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি একসময় নিয়ন্ত্রিত হতো ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা। এখন আমাদের ক্যারিয়ার সংক্রান্ত সমস্ত ভাবনা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকে যে শ্রেণী কালোবাজারি ও লুটপাট করে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছে তাদের দ্বারা। এই দুর্বৃত্তদের একটি বড় অংশ ব্যবসা ও রাজনীতির সাথে জড়িত এবং এদের লুটপাটের সহযোগী অনেক বেসামরিক-সামরিক আমলা।

এই পয়সাওয়ালাদের দুই নম্বরি জীবনযাপন দেখে এবং সেই সাথে ’৯০-এর দশক থেকে মিডিয়া ও পণ্যদাসত্বের প্রভাবে ক্যারিয়ার হয়ে উঠেছে শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। তাদের কাছে ক্যারিয়ার হচ্ছে অনেক উপার্জন করতে পারা আর বহুভাবে জৈবিক ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকতে পারা। অর্থাৎ শুধু বৈষয়িক চাহিদা পূরণ নয়, পূরণের পর যত উদ্বৃত্ত রাখা যায় সে হচ্ছে তত সফল। যেমন, আমার একটা বাড়ি দরকার।

একটার বেশি দুটো বাড়িতে তো আমি থাকতে পারব না। কিন্তু আমার ১৫টা ম্যানশন আছে, ৩০টা ভিলা আছে। কী করব ৩০টা ভিলা দিয়ে? কিন্তু আছে, এটাই আমার সাফল্য। এখন আমাদের অধিকাংশেরই ক্যারিয়ার সংক্রান্ত একমাত্র লক্ষ্য—একটি তথাকথিত সম্মানজনক পেশায় যত কম সময়ে যত বেশি সম্ভব অর্থ উপার্জন করা। আমরা ডাক্তার হয়ে বড় হাসপাতালে পাঁচ লাখ টাকা বেতনের চাকরি করার স্বপ্ন দেখি, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কমিশন পেতে চাই অথবা এমবিএ করে শুরুতেই লাখ টাকা বেতনের চাকরি চাই। সেটা যখন পারি না তখন হতাশ হয়ে পড়ি। একসময় শিক্ষকদের মধ্যে যথেষ্ট তৃপ্তি ছিল।

কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষকদের মধ্যে তৃপ্তি নয় বরং হতাশাই দেখা যায়। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা আরো বেশি। কিন্তু একসময় শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নয়, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যেও তৃপ্তি ছিল। তিনি শিক্ষক—এই আনন্দই তাকে পরিতৃপ্ত রাখত। কিন্তু এখন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষকদের কারো মধ্যেই তৃপ্তি নেই।

কারণ তাদের কাছে শিক্ষকতা কোনো মিশন নয়, এটা একটা চাকরি। তারা মনে করছেন যে, অন্য চাকরিতে বেশি উপার্জন করার সুযোগ আছে। তারা বেশি উপার্জন করতে পারছেন না, তাই তারা হতাশ হয়ে পড়ছেন। আবার যারা প্রচুর উপার্জন করছেন তারাও শান্তিতে নেই। কারণ এখন পেশাগত সাফল্যের যে সংজ্ঞা সে অনুযায়ী সফল হতে গেলে জীবনের অন্য সবদিককে অগ্রাহ্য করে টেড টার্নারের মতো অফিসে পড়ে থাকতে হবে।

ব্যবসা করতে হলে মানুষের দেহে পশুর মাথা বসাতে হবে, অর্থাৎ নিজের মানবিকতাকে বিসর্জন দিতে হবে। মানসিক প্রশান্তি স্বাস্থ্য পরিবার—সবকিছুই হারাতে হবে। যে কারণে সাইকোলজি টুডে-তে প্রকাশিত একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজনে একজন সিইও বিষণ্ণতায় ভোগেন। বহু সিইও আত্মহত্যাও করেছেন। তাই জীবিকা কখনো ক্যারিয়ার বা কর্মজীবন হতে পারে না। কর্মজীবন আরো অনেক ব্যাপক।

কর্মজীবন হলো—আমার মৃত্যুসংবাদ আমি কীভাবে দেখতে চাই, অর্থাৎ জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে পরিতৃপ্তির সাথে মারা যাওয়া। এর জন্যে প্রয়োজন এমন পেশা নির্বাচন করা—যে পেশার গন্তব্য আছে, অর্থাৎ যে কর্ম পার্থিব কল্যাণ এবং পারলৌকিক কল্যাণ দিতে পারে। আমি যা-ই করি, সেটা দিয়ে আমি যতটুকু সম্ভব মানুষের কল্যাণ করব এবং আমার মেধাকে আমি সর্বোত্তম পর্যায়ে ব্যবহার করব। এবং সেই সেবার প্রতিদান আমি পাবই।

একজন ডাক্তার যদি শুধু দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ফেলেন যে, আমি এই রোগীর সেবা করব, সে তো এমনিতেই ফিস দেবে। যেমন আমাদের দেশের একজন প্রখ্যাত ডাক্তার তার চেম্বারে সাইনবোর্ড লাগিয়ে রেখেছেন যে, আর্থিক অসুবিধা থাকলে নিঃসংকোচে বলুন। অর্থাৎ টাকার অভাবে একজন চিকিৎসা করাতে এসে আমার কাছে চিকিৎসা পাবে না—এটা যদি হয়, তাহলে আমি আমার ডাক্তারি পেশার অবমাননা করলাম। দ্বিতীয়ত, জীবনে যতগুলো দিক আছে সবগুলো দিকের মধ্যে ব্যালেন্স করে চলা।

আমি বিয়ে করলাম না, আলাদা ব্যাপার; কিন্তু বিয়ে করে আমেরিকাতে থাকলাম, শুধু উপার্জন করলাম, আমার পরিবার-পরিজন এখানে থাকল, আমার ছেলেকে আমি মানুষ করতে পারলাম না। সেটা ব্যালেন্স করা হলো না। অর্থাৎ আমার কর্মজীবনকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যেটা আমার মেধাকে বিকশিত করবে, পারিবারিক কল্যাণ করবে, সামাজিক কল্যাণ করবে এবং যে কাজের প্রতিদান আমি দুনিয়াতে পাব এবং আখেরাতেও পাব। এটিই হচ্ছে সফল ক্যারিয়ার এবং এটিই হচ্ছে সফল কর্মজীবন।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password