‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মরদেহ বহন করেছি। কিন্তু সরকারি কোনো অনুদান পাইনি। সব সময় লাশ বহনের কাজ হয় না। কোনো মাসে দু-একটি করে মরদেহ আনা-নেয়ার ভাড়া পাওয়া যায়। তরুণ বয়স থেকে এই লাশ বহন কাজে নিয়োজিত হয়ে এখন সংসার চালাতে পারছি না। অনেকবার থানার অফিসারদের বলেছি তারাও কোনো সহযোগিতা করে নাই। মরদেহ নিয়ে কাজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় অন্য কাজ করতে মন চায় না। মরদেহ বহন করতে পারলেই যেন মনে শান্তি পাই।’
বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) নওগাঁ সদর হাসপাতাল মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলছিলেন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার উত্তরগ্রামের মৃত আব্দুল মন্ডলের ছেলে শহিদুল ইসলাম (৫৩)। সরেজমিনে নওগাঁ সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, উত্তরগ্রামের শহিদুল ইসলাম হাসপাতাল গেট দিয়ে লাশ বহনকারী বাহন ভটভটি নিয়ে প্রবেশ করছে। তিনি মহাদেবপুর থানার লাশ নওগাঁ মর্গে আনা-নেওয়া করছেন। থানার লাশ বহন করা তার পেশা। একটি লাশ নিয়ে আসা বা নিয়ে যাওয়ায় প্রায় দুই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত পান এই লাশ বাহক। এ ছাড়াও বিপদগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে মরদেহ বহনের মাধ্যমে এক রকম সহযোগিতাও করেন তিনি।
এ বিষয়ে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলা কাজিপুর উপজেলার ঢেকুড়িয়া গ্রামে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় বসতবাড়ি ভেঙে গেলে পরিবারের সঙ্গে কাজের সন্ধানে নওগাঁর মহাদেবপুরে আসেন। প্রায় ৭ বছর ধরে ভুটভুটি দিয়ে সড়কে যাত্রী বহনের কাজ করতেন তিনি। হঠাৎ এক দিন উপজেলার খাজুর গ্রামের সড়ক দুর্ঘটনার একটি লোকের অর্ধগলিত মরদেহ তার গাড়িতে বাধ্য হয়ে বহন করতে হয়। তখন তার মাথায় চিন্তা আসে যে সবাই তো যাত্রী বহন করে, মরদেহ বহন করার লোক পাওয়া যায় না। মরদেহ নিয়ে পরিবারের লোকজনদেরও থানা পুলিশদের নানান বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পচন ধরা অর্ধগলিত মরদেহ গাড়িতে বহন করতে চায় না কেউ। ঠিক তখনই অর্থাৎ গত ১৯৯৫ সালে সিদ্ধান্ত নেন তিনি শুধুমাত্র লাশ বহন করবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। প্রথম দিকে লাশ টেনে বাড়ি আসার পর অস্বস্তি লাগত। বাড়ির কেউ তার সঙ্গে মিশত না। এখন সয়ে গেছে। শুধু এই পেশার কারণে আমার মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সময় অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। বর্তমানে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার নিয়ে অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। লাশ টানার জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ পাই না। মৃতের স্বজনদের কাছ থেকে সামান্য টাকা পাই।’
এ ব্যাপারে মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, ‘ তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই কাজের সঙ্গে জড়িত। থানায় তার মোবাইল নম্বর রাখা আছে। যখন প্রয়োজন পড়ে তখন শহিদুলকে ফোন করে ডেকে নেওয়া হয়। এ কাজের জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। মৃতদেহ বহনের জন্য কোনো টাকা তাকে দেওয়া হয় না। মৃত ব্যক্তির স্বজনদের কাছ থেকে ভাড়ার ব্যবস্থা করা হয় বলে জানান তিনি।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন