প্রযুক্তির ফাঁদে সম্ভ্রম হারাচ্ছে নারী

প্রযুক্তির ফাঁদে সম্ভ্রম হারাচ্ছে নারী
MostPlay

আপত্তিকর ছবি প্রকাশের নতুন ধরন সেক্সটোরশন, বছরে ১১ নারীর আত্মহত্যা, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দাবি।

প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে নারীদের ব্ল্যাকমেইল করে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে। কখনো প্রেমিক, কখনোবা স্বামী তার ব্যক্তিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিওগুলো ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দিচ্ছে। আবার অনেকে ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে ইন্টারনেটে। অনেকে গোপন ক্যামেরায় বাথরুমের চিত্র ধারণ করেও অনলাইনে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফেসবুক ও টুইটারে নারীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো এবং বাজে মন্তব্য করা এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত কিছুর পরও আইনের ফাঁক গলে অপরাধী থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু লোকলজ্জায় কোনো কিছু প্রকাশ করছেন না অনেক নারী।

দিশাহারা হয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউ। আবার একটি চক্র আন্তর্জাতিক পর্নোসাইটে আপত্তিকর এই ভিডিওগুলো বিক্রি করে টাকা কামাচ্ছে। নারীকে তার গোপন মুহূর্তের তোলা ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পরিচিত পুরুষদের কেউ কেউ তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্র্ক স্থাপনের জন্য চাপ দিচ্ছে। সাইবার ক্রাইমের নতুন এই ধরনকে প্রযুক্তিবিদরা ‘সেক্সটোরশন’ বলছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, জঘন্য এই অপরাধে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। আর এই অপরাধের জন্য অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃত্যুদন্ড করার দাবি জানান তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর দেশে সাইবার অপরাধের যেসব মামলা হয়েছে এর অধিকাংশ (৭২ শতাংশের বেশি) মামলার বিষয় ছিল, সাবেক প্রেমিক তার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে প্রেমিকার সঙ্গে কাটানো অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি অনলাইনে ভাইরাল করে দেয়। আবার অপরিচিত অনেকে ভুক্তভোগী নারীকে ধর্ষণ করে পরে ভিডিওটি অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে পুনরায় ধর্ষণ করে। এ অবস্থায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন আইনের সহায়তা নিলেও লোকলজ্জার ভয়ে বেশির ভাগ নারীই অপরাধীদের কুপ্রস্তাব নীরবে মেনে নিচ্ছেন।

অপমানজনক এ ঘটনা সইতে না পেরে এরই মধ্যে অনেক কিশোরী ও নারী আত্মহত্যা করেছেন। কেউ কেউ ভুগছেন মানসিক যন্ত্রণায়। বিবাহিত অনেক দম্পতির সংসারে ফাটল ধরেছে। আবার যৌতুকের দাবিতে অনেক স্বামী তার স্ত্রীর আপত্তিকর ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরাধী যে-ই হোক না কেন, এ ধরনের অপরাধের জন্য তাকে পর্নোগ্রাফি আইন ও ডিজিটাল অ্যাক্টের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল ও পর্নোগ্রাফি আইনে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি পর্যাপ্ত নয়। এ শাস্তি আরও বৃদ্ধি করে তা মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন করতে হবে। সাইবার ক্রাইম করে নারীর সম্ভ্রমহানি করার ফলে একজন ভিকটিম মানসিকভাবে বারবার ধর্ষিত হয়। এমনকি এ অপরাধে যারা জড়িত তা যদি প্রমাণিত হয়, তবে কোনোভাবেই অপরাধীকে ছাড় দেওয়া যাবে না। এ জন্য প্রয়োজনে পলিসি তৈরি করতে হবে।

আবার আইনের সঠিক প্রয়োগ না হলে শুধু অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে কিছু হবে না। দেখা যাচ্ছে, পর্নোগ্রাফির শিকার ভুক্তভোগীরা পারিবারিক নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছেন। এ জন্য শাস্তি আরও বৃদ্ধি করা দরকার। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের যে ধারা আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে যদি কঠোর শাস্তির বিষয়টি উল্লেখ করে কিছু সংযোজন ও সংশোধনী আনা যায়, তাহলে অপরাধ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের তথ্যে, ২০১৯ সালে ১৫.৩৫ শতাংশ ব্যবহারকারীর ছবি বিকৃত করে অনলাইনে প্রচার করা হয়। আর এর মধ্যে বেশির ভাগ ভুক্তভোগীই নারী এবং এদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দেওয়া তথ্যে, প্রতি বছর দেশে গড়ে ১১ জন নারী সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন। দেখা যায়, ফেসবুক ব্যবহারকারী অনেক নারীর ভয়ঙ্কর এই অপরাধের শিকার হওয়ার আগে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি হ্যাক হয়।

এরপর সেই অ্যাকাউন্ট থেকে ভুক্তভোগীর আপত্তিকর ছবি হ্যাকাররা পোস্ট করে। সাধারণত ব্যক্তিহিংসা চরিতার্থ করা, জোর করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়, মানসিকভাবে অত্যাচার করতে একজন অপরাধী নারীদের আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও অনলাইনে দিয়ে দেয়। কিশোরী, যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন ব্যবহারকারী, তারাই এর শিকার বেশি হয়। এ জন্য ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরাও লোকলজ্জায় ভুগছেন। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ধারা ৮(২) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তির সামাজিক বা ব্যক্তিমর্যাদার হানি করলে বা ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করলে বা কোনো সুবিধা আদায় করলে বা ব্যক্তিকে ধারণকৃত ভিডিও দিয়ে মানসিক নির্যাতন করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বিডিটাইপকে বলেন, এ ধরনের অপরাধের জন্য অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা উচিত। তবে শুধু শাস্তি বৃদ্ধি করলেই হবে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগও থাকতে হবে। যদি আইনের প্রয়োগই না হয় তবে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েও কোনো লাভ হবে না। তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার কোনো অন্তরঙ্গ ভিডিও অনলাইনে যদি ছাড়া হয়, সেটি কিন্তু ভিডিও করার সময় দুজনের সম্মতিতেই ধারণ করা হয়েছিল। এ জন্য এই ভিডিও স্বামী ও স্ত্রী যিনিই অনলাইনে ছাড়বেন, তিনিই অপরাধী হবেন। দেখা যায়, নিজের বিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা, পরিবারের অন্য ভাইবোনদেরও বিয়ে বন্ধ হয়ে পড়ার ভয়সহ বিভিন্ন চাপে বিষয়গুলো ভুক্তভোগী চেপে যান।

আবার অপরাধীরাও ভয়ভীতি দেখিয়ে ভুক্তভোগীকে বিষয়টি চেপে যাওয়ার হুমকি দেয়। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘অপরাধ যতটুকু, তার শাস্তিও ততটুকু হওয়া উচিত। আবার দেখা যায়, মামলায় জেরার ক্ষেত্রে অনেক অবান্তর প্রশ্ন করে নারীকে প্রায়ই বিব্রত করা হয়। আইন সংশোধন করে আমাদের এই বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ বিষয়গুলো যুগোপযোগী করতে হবে। পাশাপাশি মানবাধিকারের বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। সাইবার ক্রাইমে অনেক কিছু এসেছে। দেখা যাচ্ছে স্বামী ও প্রেমিকরা প্রিয়জনের আপত্তিকর ছবি অনলাইনে দিয়ে দিচ্ছে। এগুলো পোস্ট দিয়ে একজন মেয়ের চরিত্র নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে। পর্নোগ্রাফির শিকার ভুক্তভোগীরা একই সঙ্গে পারিবারিক নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে। এ জন্য এই অপরাধের শাস্তি আরও বৃদ্ধি করা দরকার। একই সঙ্গে আইনে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও রাখতে হবে।’

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বিডিটাইপকে বলেন, নারীর আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা সাইবার ক্রাইমের নতুন একটি ধরন, যাকে বলা হয় ‘সেক্সটোরশন’। এর মাধ্যমে একজনের আপত্তিকর ছবি দিয়ে যৌন হয়রানির নামে চাঁদাবাজি করা হয়। আর টাকা না দিতে চাইলে ছবিগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি প্রদান করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সী তরুণ-তরুণীরা এর ফাঁদে পড়ে। ইন্টারনেটে এ ধরনের অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের বছর বছর মানসিক অশান্তির মধ্যে থাকতে হয়। দেখা যাচ্ছে, যৌন হয়রানি সম্পর্কিত অপরাধগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্নোগ্রাফি আইনে ফেলছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ফেলছে না। ইন্টারনেট সম্পর্কিত হওয়ার পরও এগুলো তারা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ফেলছে না। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের যে ধারা আছে সেগুলো পর্যালোচনা করে যদি কঠোর শাস্তির বিষয়টি উল্লেখ করে কিছু সংযোজন ও সংশোধনী আনা যায়, তাহলে অপরাধ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password