চাইলেই পেশা ছাড়তে পারে না ছিনতাইকারীরা

চাইলেই পেশা ছাড়তে পারে না ছিনতাইকারীরা
MostPlay

‘আমি অনেক আগেই ছিনতাই পেশা ছাড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু গুরু (গডফাদার) ইয়াসিনের কারণে তা পারিনি। ইয়াসিন আমাকে জামিনে সহায়তা করেন। আমোদ-ফুর্তির ব্যবস্থা করেন। ছিনতাই করা পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে দেন। তার কাছে আমি নানাভাবে ঋণী। ঋণ পরিশোধ করতে পারছিলাম না। ছিনতাই ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানালে ইয়াসিন আমাকে এলাকা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এলাকা ছাড়তে রাজি হলে তিনি আমাকে হত্যার হুমকি দেন। যেকোনো সময় ইয়াসিন আমার বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলতে পারেন- এ আশঙ্কায় ছিনতাই ছাড়তে পারিনি।’ সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) রমনা বিভাগের হাতে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছেন ছিনতাইকারী জয়।

গ্রেফতার ছিনতাইকারী রাসেল জানান, গডফাদাররা (আশ্রয়দাতা) আমাদের রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করান। ছিনতাইয়ে অংশ না নিয়েও তারা ছিনতাইয়ের ভাগ পান। ছিনতাই ছাড়াও তারা চুরি এবং মাদক বিক্রিসহ নানা অপরাধ করান আমাদের দিয়ে। কেউ কাজ করতে না চাইলে মারধর করা হয়। অনেকটা বাধ্য হয়েই আমরা ছিনতাই করছি। আমরা চাইলেও গডফাদারদের কারণে এ পেশা ছাড়তে পারছি না। কেউ এ পেশা থেকে সরে যেতে চাইলে তাকে হুমকি ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পেশায় থাকতে বাধ্য করা হয়।

শুধু জয় বা রাসেল নয়। তাদের মতো ভুক্তভোগী ছিনতাইকারী রয়েছে আরও অনেকে। গত দুই সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে শতাধিক ছিনতাইকারী গ্রেফতার করেছে ডিবির বিভিন্ন জোনাল টিম। গ্রেফতারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে জানায়, রাজধানীতে অন্তত ২০ জন গডফাদার আছে। যারা ছিনতাইকারীদের পেশায় থাকতে বাধ্য করে। গ্রেফতারের পর জামিনের ব্যবস্থা করে।

খাবারের ব্যবস্থা করে। চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করে। মদের পার্টি দেয়। বিভিন্ন ধরনের মাদক দ্রব্যের জোগান দেয়। ছিনিয়ে নেওয়া পণ্যের বিক্রির ব্যবস্থাও করেন গডফাদাররা। মাঠ পর্যায়ের ছিনতাইকারীদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে ছিনতাই কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। বিনিময়ে ছিনতাই করা মালামালের একটি নির্দিষ্ট অংশ গডফাদাররা নিয়ে নেন। সূত্রমতে, এসব গডফাদারের চারজনকে এরই মধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে ডিবির অভিযান অব্যাহত আছে।

গত ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ থানাধীন হাইকোর্ট এলাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন ডিশ ব্যবসায়ী হামিদুল ইসলাম। ছুরিকাহত হওয়ার পর ভিকটিম দেড় ঘণ্টা রাস্তায় পড়েছিলেন। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু ঝরা পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। রক্তশূন্য অবস্থায় ঘটনাস্থলেই মারা যান হামিদুল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করে ডিবি। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সব আসামি গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা হলো সোহেল ওরফে এরাবিয়ান হোসেন, জাহিদ হোসেন, শুক্কর আলী, সোহল মিয়া, রিকশাচালক এবং হাতকাটা শাকিল ওরফে ডুম্বাস। এরপর অভিযান শুরু হয় রাজধানীজুড়ে। মাঠ পর্যায়ের ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারের পরই বেরিয়ে আসে গডফাদার চক্রের সন্ধান।

এ বিষয়ে ডিবি রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচএম আজিমুল হক যুগান্তরকে বলেন, হাইকোর্ট এলাকায় সব সময় পুলিশের তিনটি মোবাইল টিম কাজ করে। দীর্ঘসময় একটি লোক রাস্তায় কাতরাচ্ছিল। একটি টহল টিমের নজরেও সেটি না পড়ার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। ঘটনাটি আমাকে খুব পীড়া দেয়। তদন্তে নামার পর ছিনতাই চক্রের বিষয়ে ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যায়। রমনা-শাহবাগ এলাকাকেন্দ্রিক তিন গডফাদারের সন্ধান পাওয়া গেল। গ্রেফতারদের কাছ থেকে জানতে পারি, মুগদায় ছিনতাইকারীদের একটি বিনোদন কেন্দ্র আছে। হত্যার পর সেখানে গিয়ে ছিনতাইকারীরা চিত্তবিনোদন করে। সেখানে অভিযান চালিয়ে কোহিনুর বেগম মালা নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়। মালা এবং তার স্বামী ইয়াসিন হলো একটি ছিনতাই চক্রের গডফাদার। মালাকে ধরার পর ইয়াসিন পালিয়ে গেছে। পালিয়ে গেছে রমনা-শাহবাগ এলাকার আরও একাধিক ছিনতাই চক্রের দুই গডফাদার। পলাতকদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলে ডিবি কর্মকর্তা আজিমুল হক জানান।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, রাজধানীতে গডফাদাররা মূলত ভাসমান-বখাটেদের দিয়ে ছিনতাই তৎপরতা চালায়। গডফাদাররা সাধারণ লোক নয়। এরা ভদ্রবেশী অপরাধী। তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও জড়িত। নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশ নেন। তিনি বলেন, গ্রেফতার ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে তথ্যের ভিত্তিতে ২০ গডফাদারের তালিকা তৈরি করেছি। তালিকা অনুযায়ী, অভিযান চালিয়ে চারজনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছি। এদের মধ্যে ডিবির রমনা, গুলশান, তেজগাঁও এবং ওয়ারী বিভাগ একজন করে গডফাদারকে গ্রেফতার করেছে। তিনি আরও বলেন, ছিনতাইকারীদের দেয়া গডফাদারদের ঠিকানা ছাড়াও আমরা নিজস্ব সূত্রের মাধ্যমে অনুসন্ধান চালিয়ে ‘হোয়াইটকালার ক্রিমিনালদের’ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এদের আইনের আওতায় আনতে পারলেই রাজধানীতে ছিনতাই বন্ধ হবে।

ডিবির হাতে গ্রেফতারের পর রমনা-শাহবাগ এলাকার ছিনতাইকারীদের আশ্রয়দাতা মালা জানায়, হামিদুল খুনের কয়েক দিন আগেই সোহেলকে জেলখানা থেকে বের করেছি। বের হওয়ার পর একটি মেয়েকে নিয়ে টানা তিন দিন আমার বাড়িতে রাত যাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলাম। এরপর তাকে কাজে পাঠাই। মালা জানায়, মাঝেমধ্যেই তার স্বামী ছিনতাইকারী-নেশাখোরদের বাসায় ডেকে আনতেন। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে নেশা করতেন।

সূত্রঃ যুগান্তর

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password