দ্রোহে - বিদ্রোহে রাজু ভাস্কর্য

দ্রোহে - বিদ্রোহে রাজু ভাস্কর্য

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ছাত্র নামধারী কিছু সন্ত্রাসীর ক্যাম্পাস দখলের লড়াইয়ে। অস্ত্রসহ মহড়া চলছিল হাকিম চত্বর ও এর আশপাশে। হাকিম চত্বর এবং শামসুন নাহার হলের দিকে পাল্টাপাল্টি গুলি করছিল ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ। পুলিশ তখন টিএসসিতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মইন হোসেন রাজু ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। তিনি পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘আপনারা আসল অপরাধীদের দমন না করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেন আক্রমণ করছেন?’ পুলিশ আরও চড়াও হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। প্রতিবাদে টিএসসি থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বের হন। তখন তাদের ওপর গুলি করা হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাজু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র টিএসসির মোড়ে ১৯৯৭ সালের শেষের বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শ্যামল চৌধুরী ও সহযোগী গোপাল পালের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাখানের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় ভাস্কর্যটি। সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যের আটজন নারী-পুরুষ একে অন্যের হাত ধরে সন্ত্রাসদের বিরুদ্ধে ঐক্য এবং হার না মানা মুখাবয়ব প্রকাশ করছে। যাদের প্রতিকৃতিতে তৈরি সেই আটজন হলেন– মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনি।

দ্রোহে-বিদ্রোহে রাজু ভাস্কর্য সবসময় আন্দোলনের প্রতীক। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা তনু-মুনিয়া মামলা– সবসময় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ ছিল প্রতিবাদ উত্তাল। ২০২৩ সালে মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার নিয়ে আন্দোলন হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং সব ধরনের সেন্সরশিপ বন্ধের দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সব আন্দোলন দানা বাঁধে এই রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হয়েছেন সবাই।

১৯৯২ সালের সন্ত্রাস বা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান– রাজু ভাস্কর্য আজও বিদ্রোহের প্রতীক। ৬ জুন বৈষম্যমূলক কোটার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে শুরু করে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মিছিল হয়। তারপর আস্তে আস্তে আন্দোলন দানা বাঁধে। কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা জমা হতেন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে। কিন্তু সরকার পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। তখন ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে বড় জমায়েত নিয়ে রাজুর পাদদেশে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। এরপর থেকে প্রতিদিন রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল করে যেতেন শাহবাগ পর্যন্ত। কোনোদিন কারওয়ান বাজার বা ফার্মগেট পর্যন্ত। ততদিনে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনে মাঠে নেমে পড়েছেন।

১৪ জুলাই রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জমায়েতে শিক্ষার্থীদের স্লোগান ছিল ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। সেখান থেকে আন্দোলনের গতিপথ ত্বরান্বিত হয়। ১৫ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে রাজু ভাস্কর্য রূপ নেয় রক্তাক্ত প্রান্তরে। ওইদিন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলায় আহত হন অনেক শিক্ষার্থী। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ১৭ জুলাই ভিসি চত্বরে গায়েবানা জানাজার আহ্বান করা হয়। এরপর যখন কফিন মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেতে শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, তখন আবার হামলা করা হয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। সেদিন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হয়।

৫ আগস্ট কোটাবিরোধী আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে সরকারের পতন হয়। রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজয় মিছিল ছড়িয়ে পড়ে উত্তাল ঢাকা নগরীর প্রতিটি স্থানে। সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য এখন আর শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ নয়। বরং এটি এখন দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রেরণার উৎস। সবকিছু মিলিয়ে  যে কোনো আন্দোলন একটি উত্তপ্ত কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে রাজু ভাস্কর্য প্রাঙ্গণ।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password