আমাদের কষ্টের চা-পাতায় মালিক ও বাবুরা মাংস খান

আমাদের কষ্টের চা-পাতায় মালিক ও বাবুরা মাংস খান

'আমরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে চা পাতা তুলি। এই চা পাতার টাকায় বাগানের মালিক ও বাবুরা মাংস খান, কিন্তু আমাদের দিকে তাঁদের নজর নাই। ' বলছিলেন মৌলভীবাজারের নারী চা শ্রমিক অতিকা মুণ্ডা। অতিকা, নিয়তি বৈদ্যর মতো হাজার হাজার চা শ্রমিকের জীবন চা বাগান ঘিরেই কেটে যায়। তাদের নিয়তি বদলায় না, ডাক্তার-বৈদ্য দেখানোর পয়সা জোটে না।

অতিকা  বলেন, 'বর্তমানে আমাদের দিন হাজিরার ১২০ টাকা দিয়ে আলু কিনলে চাল কিনতে পারি না। চাল কিনলে ডাল কিনতে পারি না। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, ওষুধপথ্য কিনব কী দিয়ে? এ ছাড়া সারা মাসে এক টুকরো ভালো মাছ খাওয়াতে পারি না ওদের। বাগান কর্তৃপক্ষ শুধু আশ্বাস দেয়। ' স্বল্প মজুরির কারণে নিত্যপণ্যের দুর্মূল্যের বাজারে কষ্টে দিন কাটছে চা শ্রমিকদের। তাঁরা দিনে মজুরি পান মাত্র ১২০ টাকা। তা দিয়ে দেড় কেজি চালও কেনা যায় না।

এতে পরিবার-পরিজনের দুই বেলা দু'মুঠো অন্ন জোটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে কৃষিশ্রমিকের দৈনিক জাতীয় গড় মজুরি ৩৮৬ টাকা। সে অনুযায়ী চা শ্রমিকের এখনকার মজুরি এক-তৃতীয়াংশেরও কম। বর্তমান বাজারদরে ভালো মানের দেড় কেজি চাল কিনতে প্রয়োজন হয় ১২৫-১৩০ টাকা। তা দিয়ে চা শ্রমিকের গোটা পরিবারের এক দিনের আহার জোটানো দায়। ১৬৮ বছরের চাশিল্পে শ্রমিকদের এই ১২০ টাকার নিম্ন মজুরি বড়ই বেমানান বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে গত বছর চা শ্রমিক ছিল প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গে এক হাজার ৮১৮ জন শ্রমিক। বাকি শ্রমিকরা ১৫৮টি চা বাগানে কাজ করে থাকেন। নিবন্ধিত শ্রমিক প্রায় এক লাখ চার হাজার এবং অনিবন্ধিত প্রায় ৩৬ হাজার। উভয় ধরনের শ্রমিকের মধ্যে পুরুষ প্রায় ৬৯ হাজার ও নারী ৭১ হাজার। ১৮৫৪ সালে এ অঞ্চলে চা চাষ শুরু হয়। ফলে চাশিল্পের বয়স প্রায় ১৬৮ বছর। দেড় শ বছর পার হওয়ার পর চা শ্রমিকদের মজুরি ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।

এর সঙ্গে রেশন সুবিধা হিসেবে কিছু ভোগ্য পণ্যসহ অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন তাঁরা। এই আর্থিক ও অনার্থিক সুবিধাদি মিলে দৈনিক মজুরি ২০০ টাকার বেশি নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক ও লেখক ফিলিপ গাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, চা বাগানে শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার-পরিজন মিলিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ বসবাস করে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ অবাঙালি। কম মজুরি পাওয়ার কারণে চা শ্রমিকরা একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র, তেমনি সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন।

চা বাগানে তাঁরা আবদ্ধ জীবন যাপন করছেন। প্রায় পৌনে দুই শ বছরে বাগান মালিকদের অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তবে চা শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনে ছোঁয়া খুব বেশি লাগেনি। আবার মালিকপক্ষ যে রেশন দেয়, সেটি প্রায় ৪০০ টাকার সমান বলে তাঁরা দাবি করেন। কিন্তু এই দাবি মোটেই যৌক্তিক নয়। সব মিলিয়ে এখন চা শ্রমিকরা মাত্র ২০০ টাকার সুবিধা পেয়ে থাকেন।

শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নারীর প্রতি সহিংসতা, উচ্চ মাত্রায় মাতৃমৃত্যু, পুষ্টির অভাব, ভালো শিক্ষা ও বসবাস সংকট এবং কর্মস্থলে রোগবালাইয়ের আক্রমণসহ নানা সমস্যায় চা শ্রমিকরা জর্জরিত। টিলায় টিলায় শ্রমসাধ্য পাতা তুলে, মাটির ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থেকে জীবন কাটাতে হয়। সেখানে যেমন রয়েছে সুপেয় পানির অভাব, তেমনি রয়েছে স্যানিটেশনের দুরবস্থা; রয়েছে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি।

বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, নারী চা শ্রমিকদের প্রায় ১৫ শতাংশ জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে ভাবার সময় তাঁদের থাকে কম। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে এখন ১৬৭টি বাগান রয়েছে। চা চাষের ইতিহাসে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে ২০২১ সালে। উল্লিখিত চা বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান মিলে দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ২০১৯ সালে, ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি।

২০২৫ সালের মধ্যে চায়ের উৎপাদন বছরে ১৪ কোটি কেজিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছেন চাশিল্পের কর্মকর্তারা। জানা গেছে, চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে চা বাগান মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) এবং চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে প্রতি দুই বছর পর চুক্তি সম্পাদিত হয়। মূলত ২০০৭ সালে মজুরি নির্ধারিত হয় ৩২ টাকা ৫০ পয়সা। ২০০৯ সালে ৪৮ টাকা, ২০১৩ সালে ৬৯ টাকা এবং ২০১৫ সালে ৮৫ টাকা।

২০১৮ সালের চুক্তি অনুযায়ী আট ঘণ্টা শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিকদের মজুরি ১০২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত ২৩ কেজি চা পাতার চেয়ে কম পাতা উত্তোলন করলে প্রতি কেজি হিসাবে টাকা কর্তন করা হয়। এরপর ২০২০ সালে ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এই মজুরি নিয়ে চা শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। চলতি বছরে চা শ্রমিকদের মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় উন্নীত করার দাবিতে আন্দোলন করছেন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ 

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password