রোগীর ভিড় প্রতিনিয়ত, অথচ ওটি বন্ধ ৭ বছর

রোগীর ভিড় প্রতিনিয়ত, অথচ ওটি বন্ধ ৭ বছর

হাসপাতাল আছে, আছে রোগীও। নেই শুধু পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা। সাড়ে আট লাখ মানুষের ভরসার একমাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ধুঁকছে জনবল সঙ্কটে। পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। প্রতিনিয়তই রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় ২০১৪ সালে। ওই বছরের ২৫ জানুয়ারি ৫০ শয্যার হাসপাতালটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত অপারেশন (ওটি) থিয়েটারটি আর চালু হয়নি। গত সাত বছর ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সরঞ্জাম। স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসীনতায় কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। বাধ্য হয়ে জেলা হাসপাতাল ও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপালে পাঠানো হচ্ছে রোগীদের। জরুরি মুহূর্তে সেবা না পেয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসব করেছেন এক প্রসূতি মা।

সরজমিন দেখা যায়, অ্যানেসথেশিয়া মেশিন, এসি, ওটি লাইট, সার্জারি যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক বাল্ব, ওটি টেবিল, হাইড্রোলিক টেবিল, ডেলিভার টেবিল, পোর্টেবল ওটি লাইট উইথ চার্জার বা সেন্টার স্পট লাইট, লেরিংগোস্কোপ, অটোক্লেব (ইলেকট্রিক) টেবিল টপ স্টিম স্টেরিলাইজার, প্রেসার স্টিম স্টেরিলাইজারসহ (ইলেকট্রিক) সব যন্ত্রপাতি ধুলাবালি আর মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় এসব যন্ত্রপাতি ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। গাইনী চিকিৎসক ও রক্তক্ষরণ বন্ধের মেশিন না থাকায় আলোর মুখ দেখেনি অপারেশন থিয়েটার। ওটি বন্ধ থাকায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সার্জারি ও গাইনী রোগীরা কোনো সেবা পাচ্ছেন না। 

জানা গেছে, চিকিৎসক ও জনবল সংকটে এ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার (ওটি) চালু করা যাচ্ছে না। প্রসবজনিত সমস্যাসহ অপারেশনের রোগীদের শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে রংপুর মেডিক্যালসহ অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন নষ্ট থাকায় চিকিৎসাকাজ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ইসিজি মেশিন না থাকায় হার্টের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে হতদরিদ্র, বিত্তহীন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের রোগীরা আর্থিক সংকটসহ সরকারি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, এ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষের একমাত্র ভরসা এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৩১ শয্যা থেকে এটিকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও জনবলসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করায় অন্তহীন সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে চিকিৎসাসেবা। বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। মুমূর্ষ অবস্থায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার পথে ঘটছে দুর্ঘটনা। এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুত জনবল সমস্যার সমাধান করে অপারেশন থিয়েটার চালু করার।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসক ও জনবল সমস্যার মধ্যেও হাসপাতালে রোগীদের ভিড়। ডাক্তার ও এসএসএমওদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে হিমশিম খেতে দেখা যায়। এখানে শুধুমাত্র বহিঃর্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ২০০ রোগী প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে আসেন। করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধে প্রায় দৈনিক ১০০ জন টিকা গ্রহণ করেন। তাছাড়া ৫০ থেকে ৬০ জন মা ও শিশু ভ্যাকসিন সেবা নিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০টি চিকিৎসক পদের মধ্যে ৫টি পদই শূন্য রয়েছে। মেডিসিন, অ্যানেসথেসিয়া, শিশু, সার্জারি, গাইনী পদগুলো শূন্য। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় সাধারণ ডাক্তার ও এসএসএমও-রা কোনোমতে রোগীদের সেবা দেয়ার কাজ চালাচ্ছেন।

এছাড়াও এখানে একজন পরিসংখ্যানবিদ, একজন মিটওয়াইফ, ২ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, ২ জন ফার্মাসিস্ট, একজন এমটি (ল্যাব), একজন সহকারী সেবিকা, ২ জন স্বাস্থ্য পরিদর্শক, ২ জন সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, একজন টিএলসিএ, ৩ জন অফিস সহায়ক, ২ জন ওয়ার্ড বয়, একজন বাবুর্চি, একজন আয়া, ২ জন নিরাপত্তাকর্মী, ৩ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পদ শূন্য আছে।

অন্যদিকে, ৭টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হচ্ছে লাখো মানুষ। প্রতিটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে একজন মেডিক্যাল অফিসার, একজন সহকারী মেডিক্যাল অফিসার, ১ জন ফার্মাসিস্ট ও ১ জন অফিস সহায়কের পদ রয়েছে। এর মধ্যে ১টিতে মেডিক্যাল অফিসার নেই, ৪টি-তে উপসহকারী মেডিক্যাল অফিসার পদ শূন্য, ৫টিতে ফার্মাসিস্ট ও অফিস সহায়ক পদ থাকলেও আছে মাত্র ৩টি। এছাড়াও, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সহকারীর ৮৫টি পদ থাকলেও ১৭টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। ইউনিয়ন সহকারী মেডিক্যাল অফিসার ৮টি পদ থাকলেও ৮টি পদই খালি। হাসপাতালের জনবল সংকটে সেগুলোতে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। 

এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার আশরাফুজ্জামান সরকার বলেন, চিকিৎসকসহ জনবল এবং অন্যান্য সমস্যা থাকলেও আমরা রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। নানা সমস্যার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করি সহসা এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। শূন্য পদগুলো পূরণ হলে আমরা সঠিকভাবে রোগী সাধারণকে উন্নত সেবা দিতে সক্ষম হবো।

গাইবান্ধা জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার আ.ম আখতারুজ্জামান বলেন, জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসকসহ জনবল সংকট রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। পুরো জেলায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অনেক পদ খালি রয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় পদগুলো পূরণে একটু সময় লাগবে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password