প্রক্রিয়াজাত খাবারের অতিরিক্ত লবণ বাড়াচ্ছে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি

প্রক্রিয়াজাত খাবারের অতিরিক্ত লবণ বাড়াচ্ছে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি

দৈনিক অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে দেশে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্করা প্রতিদিন গড়ে ৯ গ্রাম লবণ গ্রহণ করছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রা (৫ গ্রাম) এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এর ফলে প্রতিবছর দেশে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আজ বুধবার (১৪ মে ২০২৫) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে 'বিশ্ব লবন সচেতনতা সপ্তাহ ২০২৫' উপলক্ষে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্য দেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী। মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউটের লবণ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সমন্বয়ক ডা. আহমাদ খাইরুল আবরার।

প্রবন্ধে বলা হয়, উচ্চমাত্রায় লবন গ্রহনের একটি বড় উৎস হলো প্রক্রিয়াজাত খাবার। এসব খাবার স্বাদে নোনতা না হলেও লবণের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। এই অতিরিক্ত লবণ নীরব ঘাতকের মতো দেশে হৃদরোগসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের মহামারী সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরনে অবিলম্বে একটি সমন্বিত জাতীয় লবণ গ্রহণ হ্রাস কৌশল গ্রহন করা এবং খাদ্যের মোড়কের সামনে। 'ফ্রন্ট-অফ-প্যাক লেবেলিং' বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। খাদ্য মোড়কের সামনে সহজবোধ্যভাবে দেয়া ফ্রন্ট-অফ-প্যাক লেবেলের মাধ্যমে ভোক্তারা সহজেই লবণ, চিনি ও চর্বির মত স্বাস্থ্যহানীকর উপাদানের পরিমাণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে স্বাস্থ্যকর পন্য বেছে নিতে সক্ষম হবেন। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, লবণ শুধু স্বাদের উপাদান নয়, অতিরিক্ত গ্রহণ করলে এটি হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগসহ অসংক্রামক রোগের বড় রসের ঝুঁকি তৈরি করে।

তিনি জাতীয় পাঠ্যক্রমে লবণের ক্ষতিকর প্রভাব অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান; যাতে শিশুদের মধ্যে শুরু থেকেই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান মুস্তাক হাসান মো. ইফতেখার বলেন, অধিকাংশ প্রক্রিয়াজাত খাবারে অতিরিক্ত লবণ থাকে, কিন্তু বোধগম্য লেবেলিং না থাকার কারণে জনগণ তা বুঝে উঠতে পারে না। তিনি ফ্রন্ট-অফ-প্যাক লেবেলিং ব্যবস্থা চালুর পাশাপাশি মোড়কে পুষ্টি উপাদানসমূহের সঠিক তথ্য প্রদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারীর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সরকার বদ্ধ পরিকর। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত কার্য পরিকল্পনা রয়েছে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে চলেছে। সম্প্রতি অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি উদ্যোগে জাতীয় লবণ গ্রহণ হ্রাস কৌশল প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি দ্রুত এটি বাস্তবায়ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মোড়কিকরন আইন অনুযায়ী খাদ্যের মোড়কে লবণ, চিনি ও চর্বির পরিমাণ উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক হলেও অনেক কোম্পানী তা করে না, অথবা এমন ভাবে উল্লেখ করে যা ভোক্তারা পড়তে পারে না।

জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি মোড়কিকরন আইন সংশোধন করে সহজবোধ্য ফ্রন্ট-অফ-প্যাক লেবেলিং ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় খাদ্যভ্যাস পরিবর্তনের বিকল্প নেই। তিনি দেশের জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য পরিবেশ তৈরীতে সরকারের সার্বিক প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও দেশের সুস্থ ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য তিনি সরকারী বেসরকারী সকলের সমন্বিত উদ্যোগোর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে এ জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। উল্লেখ্য, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১২ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত 'বিশ্ব লবণ সচেতনতা সপ্তাহ' পালিত হয়। এবারের স্লোগান: "অতিরিক্ত লবণ বর্জন করি, সুস্থ জীবন গড়ি।" জাতীয় পুষ্টিসেবার ডেপুটি প্রোগ্রাম প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা, আজমেরী শারমিনসহ, বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিরা বিশ্ব লবণ সচেতনতা সপ্তাহ ১২-১৮ মে, ২০২৫ খাদ্যে লুকায়িত লবণ সম্পর্কে সচেতন হোন!!!! আপনি জানেন কি? প্যাকেটকৃত খাবারে মাত্রাতিরিক্ত লবণ থাকে?? অতিরিক্ত লবণ বর্জন করি, সুস্থ জীবন গড়ি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ। প্রয়োজনের চেয়ে অধিক মাত্রায় লবণ গ্রহণের ফলে রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং উচ্চ রক্তচাপের বাঁকি বাড়ায়। উচ্চ রক্তচাপের কারনে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি রোগসহ নানবিধ অসংক্রামক রোগের মাধ্যমে মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের কারণে মৃত্যুবরণ করে।এই বাঁকি হ্রাস করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক ৫ গ্রাম বা ১ চা চাচের কম লবণ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু গবেষণায় দেয়া গেছে যে, বাংলাদেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ১ গ্রাম লবণ হণ করে, যা সুপারিশকৃত মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। আগে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যে লবণের প্রধান উৎস ছিল বাড়িতে রান্নায় ব্যবহৃত লবণ ও পাতে বাড়তি লবণ যোগ করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ন, জীবনের ব্যস্ততা, এবং খাদ্যশিল্পের প্রসারের কারণে বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় প্যাকেটকৃত ও রেস্তোরাঁর খাবার অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এসব খাবারে লবণের পরিমাণ অনেক বেশি, যা বর্তমানে লবণ গ্রহণের অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, শহর-মফস্বল-গ্রাম, শিশু-কিশোর-প্রাপ্তবয়স্ক নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রায় ৯৭% মানুষ নিয়মিতভাবে প্যাকেটকৃত খাবার গ্রহণ করে থাকে। স্বাদে নোনতা না হলেও এসব খাবারে উচ্চমাত্রায় লবণ থাকে, যা আমাদের দৈনন্দিন লবণ গ্রহণের মোট পরিমাণকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরী করে। এই কারণে, কম লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ করা এবং প্যাকেটকৃত খাদ্য কেনার আগে মোড়কের লেবেলে উল্লেখিত লবণের পরিমাণ যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একজন সচেতন ভোক্তা হিসেবে মোড়কের লেবেল পড়ে কম লবণযুক্ত পণ্য বেছে নিলে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ এড়িয়ে চলা সম্ভব হয়। যা উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে এবং অকালমৃত্যুর আশঙ্কাও অনেকাংশে হ্রাস পায়। অতিরিক্ত লবণ বর্জন করি, সুস্থ জীবন গড়ি। উচ্চ লবণ গ্রহণের স্বাস্থ্য ঝুঁকিসমূহ ,উচ্চ রক্তচাপ,স্থূলতা,হৃদরোগ,স্ট্রোক,অস্টিওপোরোসিস (হাড়ক্ষয় রোগ),পাকস্থলির ক্যান্সার,কিডনিতে পাথর ও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ। লবণ নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারনা ও বাস্তবতা "গরমের দিনে বেশি ঘাম হলে অতিরিক্ত লবণ খেতে হয়" ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে কিছুটা লবণ বের হয়, তবে তা খুবই সামান্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পানি পানই যথেষ্ট, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের প্রয়োজন নেই। "রান্নার সময় যোগ করা লবণ ক্ষতিকর নয়, পাতে লবণ গ্রহণ ক্ষতিকর" লবণের উৎস যাই হোক না কেন, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক ৫ গ্রাম বা ১ চা-চামচের বেশি লবণ গ্রহণ ক্ষতিকর সেটা রান্নার সময় হোক বা পাতে। "শুধুমাত্র বয়স্ক/ উচ্চরক্তচাপ আছে এমন মানুষের লবণ গ্রহণ কমানো উচিত" অতিরিক্ত লবণ যেকোনো বয়সেই রক্তচাপ বাড়াতে পারে। তাই সবাইকেই সচেতনভাবে লবণ গ্রহণ সীমিত রাখা উচিত।

"কাচা লবণ ক্ষতিকর, কিন্তু ভাজা লবণ নয়" কাঁচা হোক বা ভাজা সব ধরনের লবণেই সোডিয়ামের মাত্রা একই। তাই উভয়ই অতিরিক্ত গ্রহণ করলে সমানভাবে ক্ষতিকর। "পিঙ্ক সল্ট বা হিমালয়ান গোলাপি লবণ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী" পিঙ্ক সল্টে সোডিয়ামের মাত্রা প্রায় সাধারণ লবণের মতোই, যা উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি একইভাবে বাড়াতে পারে। উপরন্তু এতে আয়োডিন যুক্ত না থাকায় অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত লবণ বর্জন করি, সুস্থ জীবন গড়ি। লবণ গ্রহণ কমানোর ৯টি সহজ উপায়, ১. রান্নায় কম লবণ ব্যবহার করুন। * খাবারের স্বাদ বজায় রেখে যতটা সম্ভব কম লবণ দিন। ২. লবণের বদলে স্বাদ আনতে প্রাকৃতিক মসলা ব্যবহার করুন। আদা, রসুন, ধনে পাতা, কাঁচা মরিচ, লেবু এগুলো খাবারে স্বাদ ও গন্ধ আনে। ৩. পাতে লবণ না খাওয়ার অভ্যাস গড়ুন। টেবিলে লবণের পাত্র না রাখলে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের পরিমাণ কমে। ৪. সালাদ ও মৌসুমি ফল খেতে লবণ পরিহার করুন। সালাদ ও ফলে লবণ যোগ না করলে স্বাস্থ ঝুঁকি কমে। ৫. প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খান। চিপস, নুডলস, বিছুট, চানাচুর ইত্যাদিতে লবণের মাত্রা অনেক বেশি। ৬. প্যাকেটজাত খাবারে কেনার আগে লবণ এর পরিমাণ যাচাই করুন। মোড়কের লেবেল পড়ে কম লবণযুক্ত পণ্য বেছে নিন। ৭. বাইরে তৈরী খাবার সীমিত করুন। ফাস্টফুড বা রেস্টুরেন্টে খাবারে লবণ অনেক বেশি থাকে, তাই যথাসাধ্য পরিহার করুন। ৮. সস, আচার ও চাটনির ব্যবহার কমান। এ এ ধরনের খাবারে প্রচুর লবণ থাকে, তাই ব্যবহার সীমিত করুন। ৯. শিশুদের শৈশব থেকে কম লবণ খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ুন। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস তৈরি করুন। মনে রাখবেন, দৈনিক খাবারে মোট লবণ ১ চামচের বেশি নয়। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত শাকসবজি ও মৌসুমি ফল রাখুন,পর্যাপ্ত পানি পান করুন,সর্বদা আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ করুন,খাদ্যের মোড়কের লেবেল দেখে কম লবণযুক্ত খাবার কিনুন ,বাইরের সব ধরণের খাবার যথাসম্ভব পরিহার করুন,বাসায় কম লবণ দিয়ে রান্নার অভ্যাস গড়ে তুলুন,সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে শরীরচর্চার অভ্যাস করুন,বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ মাপুন। আপনি জানেন কি? এক চিমটি কম লবণ খাওয়ার অভ্যাস জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জনস্বার্থেঃ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এন্ড রিসার্স ইনিস্টিটিউট । প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটজাত খাদ্যে লবণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশে হৃদরোগের বোঝা কমানোর একটি পদ্ধতি উচ্চ লবণযুক্ত খাদ্য গ্রহণ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে এবং উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। বৈশ্বিকভাবে, উচ্চ রক্তচাপের হার বাড়ছে এবং এটি হৃদরোগ, যেমন হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ কারণ। বিশ্বব্যাপী, ৩০-৭৯ বছর বয়সী প্রায় ১.২৮ বিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, যা প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি মৃত্যুর জন্য দায়ী। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ খাদ্যজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) দৈনিক সর্বাধিক ৫ গ্রাম (২ গ্রাম সোডিয়াম) লবণ গ্রহণের পরামর্শ দেয়।বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের প্রাদুর্ভাব ২১%, যা প্রতি বছর ০.৫১% হারে বাড়ছে। অকাল মৃত্যুর ৭০% হলো অসংক্রামক রোগ (NCDs) থেকে, যার মধ্যে ৩৪% একা হৃদরোগ (CVD) থেকে।

বাংলাদেশের মানুষ WHO-এর সুপারিশকৃত দৈনিক লবণের পরিমাণের প্রায় দ্বিগুণ (প্রায় ৯ গ্রাম/দিন) লবণ গ্রহণ করে। উচ্চ লবণ গ্রহণের অন্যতম কারণ হলো প্রক্রিয়াজাত খাবারের বৃদ্ধি ও বাড়তি লবণের ব্যবহার। ঐতিহ্যগত রীতি এবং সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়ম, যেমন খাওয়ার সময় প্লেটে লবণ রাখা, খাবারের আগে ও পরে লবণ খাওয়া, উচ্চ লবণযুক্ত আচারের ব্যবহার এবং মৌসুমি ফলের সাথে লবণ ব্যবহার করা, উচ্চ মাত্রায় লবণ গ্রহণে অবদান রাখে। WHO সর্বাধিক দৈনিক ৫ গ্রাম লবণ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। বাংলাদেশি জনগণ WHO সুপারিশের প্রায় দ্বিগুণ লবণ গ্রহণ করে। ৯৭% বাংলাদেশি জনগণ প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটজাত খাবার (PPF) গ্রহণ করে। বিশ্লেষণ করা ৬২% PPF-এ উচ্চ লবণ পাওয়া গেছে। ৪২% PPF প্যাকেটে উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে বেশি লবণ ধারণ করে।শুধু ৪% জনগণ প্যাকেটের পুষ্টিগুণের তথ্য পরীক্ষা করে।দ্রুত নগরায়ন এবং প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটজাত খাদ্যের (PPF) ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে স্থূলতা ও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে WHO সদস্য রাষ্ট্রগুলো জনসংখ্যার লবণ গ্রহণ ৩০% কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

বাংলাদেশের জাতীয় পুষ্টি নীতি (National Nutrition Policy) প্রক্রিয়াজাত খাবারের ব্যবহার সীমিত করতে জনগণ এবং উৎপাদকদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়াজাত খাবারের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেয়, পাশাপাশি পুষ্টি লেবেলিং বাধ্যতামূলক করা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারাকে সমর্থন করে। প্যাকেটের সামনের অংশে পুষ্টি তথ্য প্রদান (Front-of-Package Labeling, FOPL) গ্রাহকদের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতন করার সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (BFSA) গৃহীত 'প্যাকেজড ফুড লেবেলিং রেগুলেশন' অনুযায়ী, প্যাকেটজাত খাবারে লবণের পরিমাণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। তবে, এই পণ্যে লবণের মান নির্ধারণের জন্য এখনো কোনো মানদণ্ড নেই।বাংলাদেশের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন (NHFB) সম্প্রতি একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে, যার লক্ষ্য ছিল সাধারণত ব্যবহৃত প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটজাত খাদ্যের লবণের পরিমাণ নির্ধারণ করা এবং প্যাকেটের লেবেলে ঘোষিত লবণের পরিমাণ ও বাস্তব পরিমাণের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করা। এই গবেষণায় গ্রাহকদের লেবেল ব্যবহারের আচরণ মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং লেবেল ব্যবহার না করার প্রতিবন্ধকতাগুলোও চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটজাত খাদ্য (PPF) গ্রহণ কমিউনিটি-ভিত্তিক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত প্যাকেটজাত খাদ্যের (PPF) ব্যবহার অত্যন্ত বেশি। প্রায় ৯৭% জরিপকৃত জনগণ প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার PPF গ্রহণ করে। সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করা হয় বিস্কুট (৭৮%), এরপর চানাচুর (৫৩%), নুডলস (৫২%), চকলেট (৪০%), চিপস (৪৫%), কেক (৪২%), এবং পাউরুটি (৩১.৫%)। এই খাবারের ব্যবহার সকল জনগোষ্ঠী ও ভৌগোলিক অঞ্চলে উচ্চ। বাজার জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য বাজার জরিপে দেখা গেছে, মোট ১৩৯৭টি খাদ্যপণ্য জরিপকৃত খুচরা দোকানে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বিস্কুট, এরপর চকলেট ও চিপস। সাধারণত ব্যবহৃত PPF-এ লবণের পরিমাণ ল্যাবরেটরিতে ১০৫টি PPF পণ্যের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বেশিরভাগ PPF-এ উচ্চ মাত্রার লবণ রয়েছে।

বিশ্লেষিত PPF-এর ৩৫.২% পণ্যে অত্যন্ত উচ্চ লবণ (১.৫ গ্রাম/১০০ গ্রাম খাদ্য থেকে বেশি), ২৬.৭% পণ্যে মাঝারি উচ্চ লবণ (০.৭৫-১.৫ গ্রাম/১০০ গ্রাম খাদ্য) পাওয়া গেছে। মাত্র ৩৮.১% পণ্য গ্রহণযোগ্য লবণের মাত্রা (<০.৭৫ গ্রাম/১০০ গ্রাম খাদ্য) রয়েছে। লবণের মাত্রা যুক্তরাজ্যের ট্রাফিক লাইট সিস্টেম এবং মেক্সিকো FOPL সিস্টেম অনুযায়ী শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। বাস্তব এবং লেবেলে উল্লিখিত লবণের পরিমাণের তুলনা প্যাকেটের লেবেলে ঘোষিত লবণের পরিমাণের সাথে ল্যাবরেটরিতে নির্ধারিত লবণের পরিমাণ তুলনায় দেখা যায় যে, মাত্র ২৫.৭% PPF সঠিকভাবে লবণ বা সোডিয়ামের পরিমাণ উল্লেখ করেছে। ৪২% PPF-এ লেবেলে উল্লেখিত লবণের পরিমাণ প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে কম ছিল। যদিও প্যাকেটজাত খাদ্যে পুষ্টি তথ্য উল্লেখ বাধ্যতামূলক, ৮.৬% PPF-এর প্যাকেটে লবণের পরিমাণের কোনো তথ্য ছিল না। বাংলাদেশি ভোক্তাদের প্যাক লেবেল ব্যবহারের অভ্যাস কমিউনিটি-ভিত্তিক জরিপে দেখা গেছে, ৫৬.৭% অংশগ্রহণকারী অন্তত একটি উপাদান পরীক্ষা করেন। বেশিরভাগ ভোক্তা ব্র্যান্ডের নাম এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ পরীক্ষা করেন। মাত্র ৪% ভোক্তা প্যাক লেবেলে পুষ্টি তথ্য পরীক্ষা করেন।

লেবেল ব্যবহারের প্রতিবন্ধকতা এবং তা দূর করতে নীতিগত সুপারিশবিভিন্ন গ্রুপের ভোক্তাদের সাথে আলোচনায় দেখা গেছে যে, ছোট ফন্ট সাইজ, খারাপ রং ব্যবহারের ফলে লেবেলের তথ্য বোঝা কঠিন হয়। তাছাড়া, অপরিচিত শব্দ ব্যবহারও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রধান ভোক্তা-স্তরের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে কম সাক্ষরতা হার, কেনাকাটার সময়ের অভাব, পুষ্টিগত তথ্যের প্রতি আগ্রহের অভাব এবং কোম্পানি-প্রদত্ত পুষ্টি মানের উপর অবিশ্বাস। এই আলোচনার অংশগ্রহণকারীরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, সকল প্যাকেটজাত খাদ্যে একটি সহজবোধ্য লেবেলিং সিস্টেম ব্যবহার করা উচিত যা সহজে পড়া যায়, গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি তথ্য এক নজরে দেওয়া যায়। ফ্রন্ট-অফ-প্যাক লেবেলিং (FOPL) ব্যবস্থার প্রবর্তন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে। পুষ্টি লেবেল পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম এবং গণমাধ্যমে প্রচার চালানো উচিত। লবণ গ্রহণ কমানোর জন্য অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ: ১. লবণ গ্রহণ কমানোর নীতি একটি খাদ্য পরিবেশ তৈরি করা যেখানে মানুষ কম লবণযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে একটি লবণ গ্রহণ কমানোর নীতি প্রয়োজন। এই নীতি সরকারী সংস্থা, একাডেমিয়া এবং খাদ্য শিল্পকে উপযুক্ত কর্মসূচি উন্নয়নে সহায়তা করবে।

২. প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে লবণের সর্বাধিক মাত্রা নির্ধারণ WHO গ্লোবাল সোডিয়াম বেঞ্চমার্কের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে সর্বাধিক লবণের মাত্রা নির্ধারণে একটি সুনির্দিষ্ট আইন বা নিয়ম প্রয়োজন। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। ৩. লেবেলিং নিয়ম প্যাকের পিছনে পুষ্টি প্যানেলে স্পষ্ট ও সহজে পড়ার মতো লবণ সম্পর্কিত তথ্য থাকা উচিত। FOPL চালু করা উচিত, যা দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। ৪. ভোক্তা শিক্ষামূলক কর্মসূচি অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ক্ষতিকর প্রভাব এবং লেবেল থেকে সঠিক তথ্য কীভাবে পড়তে হয়, সে সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতন করতে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো উচিত। ৫. গণসচেতনতা বৃদ্ধি বাড়িতে রান্নার সময় লবণ ও মশলার ব্যবহার কমানোর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক খাদ্য গ্রহণে উৎসাহিত করা উচিত। ৬. সোডিয়াম হ্রাস প্রচার শুধুমাত্র শিক্ষামূলক পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। বাধ্যতামূলক নিয়ম বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে লবণ গ্রহণের লক্ষ্য অর্জন করা যায়।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password