উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতে ক্ষণজন্মা তারেক মাসুদ কেন অনন্য?

উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতে ক্ষণজন্মা তারেক মাসুদ কেন অনন্য?
MostPlay

ফরিদপুরের ভাঙায় ১৯৫৬ সালে জন্ম নেয়া তারেক মাসুদ মাদরাসা পড়ুয়া অন্যান্য দশজন শিক্ষার্থীর মতোই ছোটবেলায় 'সিনেমা' সম্পর্কে তেমন একটা জানতেন না। শৈশব-কৈশোরে সিনেমা দেখাও হয় নি তাঁর। আশ্চর্য হওয়ার মতো ব্যাপার হলেও সত্যি যে এই মানুষটিই একসময় হয়ে ওঠেন আমাদের চলচ্চিত্র জগতের একজন প্রতিশ্রুতিশীল নির্মাতা,চিন্তাশীলতার জাগরণকারী একজন গুণী চিত্রনাট্যকার,চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক। বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা এবং বিশ্বের দরবারে চিন্তাঋদ্ধ বাংলা চলচ্চিত্রের সুখ্যাতি ছড়িয়ে দেয়া কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য 'পথের পাঁচালি' সিনেমাটিই ছিল তারেক মাসুদের দেখা প্রথম কোনো সিনেমা। 


রুচিশীলতা,সূক্ষ্ম জীবনবোধের সাথে সমসাময়িক সমাজের নিগূঢ় বাস্তবতা,সমস্যার প্রেক্ষাপট এবং উত্তরণের উপায় সম্পর্কে ধারণা দেয়া তারেক মাসুদের নির্মাণগুলো আমাদের চিন্তা করতে শেখায়,ভাবতে শেখায়,ইতিহাস- সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কে করে তোলে সচেতন। ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে 'মাওলানা' পাস করা এই সৃষ্টিশীল মানুষটির মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। পরবর্তীসময়ে তিনি আবার কলেজে ভর্তি হয়ে এইচএসসি সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্নাতক করার সুযোগ পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে তিনি ফিল্ম এপ্রিসিয়েশনের উপর কোর্স করেন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে। ধর্ম,দর্শন,আধুনিক বিজ্ঞান,শিল্পকলা,সাহিত্য,লোকসংস্কৃতি,স্থাপত্য,সমাজ ও রাজনীতিসহ জ্ঞানের নানান শাখায় তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। চলচ্চিত্র জগতে গুরু হিসেবে পাওয়া আলমগীর কবিরের এই শিষ্য ব্যক্তিজীবনে আহমদ ছফা দ্বারাও হয়েছিলেন বেশ প্রভাবিত। চলচ্চিত্র জগতের তানভীর মোকাম্মেল,মোরশেদুল ইসলামকে যেমনি পেয়েছিলেন সঙ্গী হিসেবে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন ড. সলিমুল্লাহ খানের মতো দর্শন,সাহিত্যানুরাগী একজন গুণীকে। তিনি একবার তাঁর ইচ্ছের কথা এভাবে বলেছিলেন, 'চলচ্চিত্রকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম। '

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই তারেক মাসুদ প্রামাণ্যচিত্র,স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে জড়িত ছিলেন। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের উপর নির্মিত সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়া 'আদম সুরত' তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম প্রামাণ্যচিত্র । তাঁর 'মুক্তির গান' আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক দলিল স্বরূপ। তারেক মাসুদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'মাটির ময়না' প্রথম কোনো বাংলাদেশি বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। নিজের মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতাকে তিনি গভীর মমত্ববোধ,জীবনবোধ, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং আমাদের সমাজ বাস্তবতার নিরিখে এত দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন যে দেশ এবং দেশের বাইরের দর্শক,চলচ্চিত্র সমালোচকেরা মুগ্ধ না হয়ে পারেন নি। তাঁর আরেকটি চলচ্চিত্র 'রানওয়ে' বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদ,মৌলবাদ এবং ধর্মীয় অন্ধত্ব বিরোধী একটি রাজনৈতিক এবং সামাজিক চলচ্চিত্র যা আমাদের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে,সমস্যার গভীরে নিয়ে যায় এবং উত্তরণের পথ বাতলে দেয়৷ কোনো ধর্ম,গোষ্ঠীকে দায়ী না করে গভীর নীরিক্ষাধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি এবং দরদের সাথে কীভাবে প্রকৃত চিত্রটিকেই তুলে ধরা যায় সে ব্যাপারে তিনি তাঁর অনন্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন। 

তারেক মাসুদ যে শুধু সিনেমার নক্ষত্র আলোক বাংলাদেশের মধ্যেই আবদ্ধ রেখেছিলেন তা নয়,তিনি সেই জ্যোতি ছড়িয়ে সমগ্র উপমহাদেশে এমনকি বিশ্বের সচেতন দর্শক,সমালোচকদের দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কান থেকে শুরু করে অস্কার সবখানেই তিনি হয়েছেন আলোচিত। জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক বক্তব্যকে এত সরলভাবে নিখুঁত ভঙিমায় চলচ্চিত্ররূপে নান্দনিকতার মিশেলে মানুষের সামনে তুলে ধরে তিনি তাঁর মেধা ও মননের যে পরিচয় দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে অনন্য,অতুলনীয়। খুব অল্প সময়েই তিনি চলচ্চিত্রজগতের একজন প্রবাদ পুরুষে পরিণত হয়েছিলেন। 

কলাকৌশল,mise-en-scene,প্লট,চিত্রনাট্যসহ সার্বিক ব্যাপারেই তারেক মাসুদ সচেতনতার সাথে নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে পেরেছিলেন যা তাঁকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল নির্মাতার কাতারে নিয়ে গিয়েছিল। ধর্মের মতো স্পর্শকাতর ব্যাপারে নিজের সচেতন ও যত্নশীল বক্তব্য উপস্থাপন করে তিনি সুস্পষ্ট প্রতিভার যে স্বাক্ষর রেখেছেন তা আমার কাছে একরকম অবিশ্বাস্যই মনে হয়। এই জায়গাটিই তাঁর কৃতিত্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক। ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষা করে প্রচলিত ধর্মমতের নেতিবাচক দিকগুলোকে সমাজের প্রত্যক্ষ চিত্রকলায় তিনি নিজের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন,যা তরুণ সমাজকে প্রশ্ন করতে শেখায়,ভাবতে শেখায় এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে বুঝিয়েও দেয় সমস্যার সমাধান কী হতে পারে! দর্শকদের মননে আঘাত করে বুদ্ধিবৃত্তিকে মুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করে তাঁর নির্মাণশৈলী৷ 

আমাদের দুর্ভাগ্য যে তারেক মাসুদের মৃত্যুও হয়েছিল তাঁর চলচিত্র গুরু,বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক কাণ্ডারী আলমগীর কবিরের মতোই; অকালমৃত্যু। ফেরিঘাটের দুর্ঘটনায় আলমগীর কবিরের মৃত্যুর প্রায় দুই যুগ পর তাঁর শিষ্য উপমহাদেশের চলচ্চিত্রজগতের ত্রাণকর্তা মহাপুরুষ তারেক মাসুদ মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মানিকগঞ্জে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর সাথে থাকা সাংবাদিকতা,গণমাধ্যম এবং ফটোগ্রাফি জগতের আরেক নক্ষত্র মিশুক মুনীরও মৃত্যুকে করেন আলিঙ্গন৷ সেসময় তাঁরা 'কাগজের ফুল' চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের স্থান দেখতে যাচ্ছিলেন মাইক্রোবাসে করে। চলচ্চিত্রজগতের অনন্য কীর্তিমান এই গুণীজনকে আমরা হারিয়ে ফেললেও তাঁর নির্মাণগুলো আমাদের হাতে রয়েছে । রুচিহীন,হালকা,মানহীন চলচ্চিত্রের ভিড়ে,সামাজিক অবক্ষয়ের এই ক্রান্তিলগ্নে তারেক মাসুদ চর্চা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। অবধারিত হয়ে দাঁড়িয়েছে 'সোনার বেড়ি','মুক্তির কথা','নারীর কথা','অন্তর্যাত্রা','নরসুন্দর'- এর মতো শক্তিশালী সামাজিক,ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বক্তব্যে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র ধারণ করা,লালন করার ব্যপারটি।

লেখালেখি,সভা,সেমিনার,বক্তব্য,প্রদর্শনী,আলোচনার মাধ্যমে তারেক মাসুদ এবং তাঁর চলচ্চিত্রগুলো সম্পর্কে বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যতের শিক্ষার্থী,তরুণ সমাজ এবং দর্শকদের অবহিত না করে এই গুণীজনকে অবজ্ঞা আর অবহেলা করার ফল আমাদের জাতির জন্য হবে ভয়াবহ। 


লেখকঃ মো.রিদওয়ান আল হাসান,

শিক্ষার্থী,গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password