কেন থামছে না নারীর প্রতি সহিংসতা

কেন থামছে না নারীর প্রতি সহিংসতা
MostPlay

মনিরা নাজমী জাহান

নারীর প্রতি সহিংসতা আমাদের দেশে এক নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে এমন কোনো একটি দিন পাওয়া যাবে না যে দিন বাংলাদেশের কোনো না কোনো প্রান্তে কোনো না কোনো নারীকে প্রতিহিংসার শিকার হতে হচ্ছে না। এই ভয়াবহ জঘন্য অপরাধটি যেন আমাদের যাপিত জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই অপরাধ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। সমাজ যেন মেনেই নিয়েছে যে নারীর প্রতি হিংসা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। নারীর জন্মই যেন হয়েছে প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার জন্য। এই ভয়াবহ অপরাধের মাত্রা যত বেড়ে চলছে সমাজ ততই নির্বিকার হয়ে পড়ছে। শুধু নির্বিকার হওয়া নয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজ বরং এই নারীর প্রতি সহিংসতাকে বিভিন্নভাবে জায়েজ করার চেষ্টা ও চালাচ্ছে। সমাজের এ রূপ বিরূপ আচরণের ফলে ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে নারীর প্রতি সহিংসতা।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৫১ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন ৫৫৪ জন নারী যাদের মধ্যে ২৪০ জনকে তাদের স্বামী হত্যা করে। অথচ এই ২০২০ সালে করোনা নামক ভয়াবহ ভাইরাস যা স্তব্ধ করেছিল গোটা পৃথিবীকে।

এই ভাইরাইসের কবলে পড়ে পৃথিবীতে এমন কোনো সেক্টর নেই যেই সেক্টরের চাকা থমকে যায়নি। কিন্তু এই ভয়াবহ করোনাভাইরাসও পারেনি নারী নির্যাতনকে থামাতে। করোনা নামক মহামারি বাতাসের সাথে ছড়িয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে মানবসভ্যতার আলো, মানুষ যখন প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে তখন থেমে থাকেনি নারী নির্যাতন। নারী শুধু ঘরের বাইরে নয় নিজ ঘরেও নিরাপদ ছিল না এই করোনাকালে। ২৪০জন নারীকে তাদের স্বামীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে।

আমরা যদি গত কয়েক বছরের পরিস্থিতি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব গণমাধ্যমে প্রকাশিত উচ্চ আদালতে দাখিলকৃত পুলিশ সদরদফতর থেকে প্রেরিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে থানাগুলোতে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩৩১টি, ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৬৮৩টি, ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৬৯৫টি, ২০১৯ সালে ৬ হাজার ৭৬৬টি ও ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৬ হাজার ২২০টি মামলা দায়ের করা হয়। প্রতি বছর এই মামলার পরিমান আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে। এ তো গেল দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা কিন্তু এর চেয়ে আরও অনেকগুণ বেশি ঘটনা ঘটে থাকে যেসব সহিংসতার ঘটনা মামলা পর্যন্ত যেতেই পারে না। তার আগেই ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্নভাবে ধামাচাপা দিয়ে দেয়া হয়।

ডিজিটাল বাংলাদেশের নারীরা অনলাইনেও নিরাপদ নয় সেখানেও তাদের শিকার হতে হয় বিভিন্ন রকম সহিংসতার। বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ২০১৯ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগী নারীদের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০১৯ সালে ভুক্তভোগী নারীদের হার ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ। যেটা ২০১৮ সালে ছিল ৫১ দশমিক ১৩ শতাংশ।

এছাড়াও গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে এখন পর্যন্ত বিশেষ ইউনিটের হটলাইনে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি সাইবার অপরাধের শিকার নারী কল করেছেন। এর মধ্যে ফেক ফেসবুক আইডি সংক্রান্ত অভিযোগ ২৩ শতাংশ, আইডি হ্যাক সংক্রান্ত ১৩ শতাংশ, ব্ল্যাকমেইলিং সংক্রান্ত ৮ শতাংশ, মোবাইল হ্যারাজমেন্ট সংক্রান্ত ৯ শতাংশ, অশ্লীল কন্টেন্ট পাঠানো সংক্রান্ত ৭ শতাংশ, অন্যান্য ৯ শতাংশ এবং অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগ আসে ২৭ শতাংশ।

ভাবতে অবাক লাগে যে, যখন বাংলাদেশ নিজস্ব স্যাটেলাইটের যুগে প্রবেশ করছে তখন বাংলাদেশের নারীদের জীবনে ঘটে চলছে ভয়াবহ সহিংসতা।নারীর দৈনন্দিন জীবনে এমন কোনো স্থান বা সম্পর্ক পাওয়া যাবে না যেখানে বা যেই সম্পর্ক দ্বারা নারী সহিংসতার স্বীকার হচ্ছে না। আমরা কি কখনো চিন্তা করেছি আইন পরিবর্তন হচ্ছে, শাস্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে তবুও কেন কমছে না নারীর প্রতি সহিংসতা? সহিংসতা এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে নারীর প্রতি সহিংস ঘটনা ঘটে যাবার পর সেই ঘটনাকে ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে এবং সেই ধারণকৃত ভিডিওকে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে আবার ও একই অপরাধ করছে অপরাধী। এমনকি নারীর মৃতদেহকেও ধর্ষণের মতো বীভৎস ঘটনা আমরা দেখতে পেয়েছি।

নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে নারীকে ভয় দেখিয়ে নারীর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। এই ঘুনে ধরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো নারীর উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর ওপর সহিংসতা চালিয়ে নারীর উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করা হয়।নারীর কোনো অর্জন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মেনে নিতে পারে না। নারীকে কুক্ষিগত করার এক প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকে এই ঘুনে ধরা সমাজে। নারীর যেকোনো অর্জনে হিংসার আগুনে জ্বলে ওঠে এই সমাজ। এই অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে হেন কোনো জঘন্য কাজ নেই যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা করে না। শুধু নারীর প্রতি প্রতিহিংসা নয় এই প্রতিহিংসাকে বৈধতা দিতে এবং এই প্রতিহিংসাকে উসকে দিতে এই ঘুনে ধরা সমাজব্যবস্থা এমন কোনো কুকর্ম নেই যে করে না।

বিভিন্ন অজুহাত তথা পর্দা না করার কারণে, একা চলাচলের কারণে, রাতে চলাচল প্রভৃতি বলে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতাকে এক ধরনের বৈধতা দেবার চেষ্টা করে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা জানে যে একজন নির্যাতিতা নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেই নারীকে মানসিকভাবে দুর্বল করা সম্ভব।

মানসিকভাবে দুর্বল করা গেলে একজন নারীর ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করার শক্তি অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়বে। সব জেনেবুঝে তাই এই বীভৎস সমাজ নারীকে দুর্বল করার জন্য তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার কুৎসিত খেলায় মেতে ওঠে। একটি সমাজব্যবস্থা কতটা নোংরা হলে একজন নির্যাতিতা নারীর পক্ষে না দাঁড়িয়ে বরং তার ন্যায়বিচার পাবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।

যে দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়, সামাজিক মাধ্যমে নারীর নারীকে নিয়ে ট্রল করা হয়, বডি শেমিং করা হয় এমনকি মূলধারার গণমাধ্যমেও বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে নারীকে আপত্তিকরভাবে উপস্থাপন করা হয় সে দেশে আসলে নারীর প্রতি প্রতিহিংসা নিয়ন্ত্রণ কতটুকু সম্ভব? যে সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে আপস করা হয়, যে সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি প্রতিহিংসা উসকে দিতে পারে সেই সমস্ত কাজ নির্বিচারে চলে সেই সমাজে আইন করে, শাস্তি বাড়িয়ে নারীর প্রতি প্রতিহিংসা আদৌ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? যে সমাজে ধর্ষক নয় বরং ধর্ষণের শিকার নারীটিকে খারাপ চোখে দেখা হয় সেই সমাজ কি আসলে সভ্যসমাজ?

তাই নারীর প্রতি প্রতিহিংসা তখনই কমবে যখন দেশে নারী জাগরণ নিশ্চিত হবে। এই নারী জাগরণ নিশ্চিত করতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি নারীর মধ্যে। আর এই নারী জাগরণের লড়াইয়ে প্রতিটি নারীকে অবশ্যই শামিল হতে হবে। কারণ নারীর জাগরণ ছাড়া একটি সমাজে নারীমুক্তি আসতে পারে না, আর নারীমুক্তি ব্যতীত সামগ্রিক অর্থে একটি সভ্যসমাজ গড়া অসম্ভব।

লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password