মেয়েশিশুদের ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে হবে

মেয়েশিশুদের ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে হবে
MostPlay

ইরানী বিশ্বাস

শিশুরাই দেশের ভবিষ্যত। আজকের শিশুই আগামীর দেশ নায়ক। অথচ এই শিশুরাই মনে সংশয় নিয়ে ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় নীতিতে নেই সঠিক প্রস্তুতি। কারণ শিশুর জন্মের পর থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত আত্মরক্ষা বা যৌনরক্ষার মতো শিক্ষা তারা পায় না বললেই চলে। পরিবার কিংবা স্কুলে শিক্ষা দেওয়া হয় না, কিভাবে যৌন সুরক্ষা করতে হবে।

যদি তাদের সঠিকভাবে জানানো হতো, শরীরের তিনটি জায়গা যেমন বুক, হিপ বা পিছনের অংশ এবং সামনে নাভির নীচের অংশ মা ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করাকে যৌন নিপীড়ন বলে, তাহলে তারা সহজেই ধর্ষক ও যৌন নিপিড়কের হাত থেকে রক্ষা পেত। এ শিক্ষা না থাকার কারণে শিশুরা বিশেষ করে কন্যা শিশুরা প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ২০১৮ সালের এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি চারজন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন আর প্রতি ছয়জন ছেলে শিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এই জরিপে দেখা গেছে, শুধু পুরুষই দ্বারাই নয়, কখনো কখনো নারী দ্বারাও শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।

 শিশুর যৌন নিপীড়ন ঠেকাতে সরকারের আইনের পাশাপাশি শিশুদের সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন পারিবারিক জনসচেতনতা। বর্তমান সময়ে মানুষের মানবিক গুণাবলী লোপ পাচ্ছে। মানবিক গুণাবলীর চর্চা প্রয়োজন। তাছাড়া, ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় সাধারণ মানুষ তার অপপ্রয়োগ ঘটাচ্ছে। এ সাথে শিশুদের নিজেদের রক্ষায় তাদের আত্মরক্ষার কৌশল শিখানো প্রতিটি অভিভাবকের দায়িত্ব। 

ধর্ষণকে সাধারণত পুরুষের জৈবিক তাড়না হিসেবে দেখা হয়। তবে শুধু জৈবিক কারণে শিশু ধর্ষণ হয়, তা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। অনেক সময় ব্যক্তিগত, সামজিক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েও ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামাজিক মর্যাদাহানির কারণে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ পায় না বা প্রকাশ করা হয় না। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪শত টি।

২০১৭ সালের আদমশুমারি অনুসারে দেশে কন্যাশিশুর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এসব কন্যাশিশু ঘর-ঘরের বাইরে এমনকি ঘরের অন্দর মহলেও নিরাপদ নয়। দেখা গেছে শিশু সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আপনজন, পরিচিতজনদের দ্বারা। এমনকি শিক্ষক, গৃহ শিক্ষক, প্রতিবেশি, নিকট আত্মীয়রাও শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানিসহ ধর্ষণ-গণধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে।

অনেক ক্ষেত্রে লোক লজ্জার ভয়ে বা পারিবারিক কোন্দলের কারণে অনেক পরিবারই চেপে যান বিষয়টা। তবে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন মোটেই সামান্য বিষয় নয়। শিশু মনে থেকে যাওয়া এ বিষয়টি তার মানসিক অসুস্থতা, হতাশাসহ আরো ভবিষ্যতে অনেক বড় বিপদ ঘটাতে পারে। এতে করে শিশু মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক ভারসাম্য হারানোর মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলেছে, বাংলাদেশে শতকরা ৯৫ ভাগ মেয়েশিশু আর শতকরা ৫ ভাগ ছেলে শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। শিশুদের যৌন হয়রানির মধ্যে ধর্ষণ ছাড়াও তাদের ওপর নানা ধরনের শারীরিক আক্রমণ, বলাৎকার, স্পর্শকাতর ও যৌনাঙ্গে অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করার মতো ঘটনাও অহরহ ঘটছে। নানা কারণে প্রতিবছর কন্যাশিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা বাড়ছে, যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে সব নির্যাতনের রেকর্ড প্রকাশ পায় না।

ডয়েচে ভেলের তথ্যানুয়ায়ী, বাংলাদেশে ধর্ষণের হার প্রতি লাখে ১০ জন এবং সমগ্র বিশ্বে অবস্থান ৪০তম। ধর্ষণের ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, সেখানে প্রতি লাখে ১৩২ জন ধর্ষিত হয়। এছাড়া লেসোথোতে প্রতি লাখে ৯৩ জন, বোতসোয়ানায় ৮৩ জন, সোয়াজিল্যান্ডে ৭৮ ও সুইডেনে ৬৩ জন। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে প্রতি লাখে ৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়, যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ বলেছে, সারাদশে ২০২০ সালে প্রথম ৯ মাসে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে এক হাজার ৭৮ জন শিশু, যাদের অধিকাংশই কন্যাশিশু। করোনাকালে আগের তুলনায় শিশু যৌন নির্যাতন বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ।

জীবিকার জন্য বহু পরিবারের বাবা-মা দু’জনই চাকরি করেন। দেশে এখনো সেভাবে ডে-কেয়ার সেন্টার চালু হয়ে ওঠেনি। ফলে নিরুপায় হয়ে শিশুকে পাশের বাসায় বা কোনো আত্মীয়ের বাসায়, পরিচিতদের বাসায়, গৃহকর্মী বা ড্রাইভারের কাছে একা রেখে যেতে হয়। বিশ্বাস করে যাদের কাছে প্রাণপ্রিয় সন্তানকে রেখে যান মা-বাবা, অধিকাংশ নিন্ম আয়ের মানুষদের মধ্যে এ ঘটনা ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। বস্তি বা কম ভাড়া বাসাগুলিতে মানুষ ঘরবন্দী থাকে না। তারা সার্বক্ষণিক ঘরের দরজা খোলা রাখে এবং একে অন্যের ঘরে অবাধ যাতায়াত করে। সে ক্ষেত্রে সহজেই শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে। এমনকি স্কুল, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও শিশুদের নিগ্রহের শিকার হতে হয়। শিশুদের নিরাপত্তায় অভিভাবকদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

যৌন নিগ্রহ যে শুধু নিন্মবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের মধ্যেই বেশি ঘটে, তা নয়। উচ্চবিত্ত পরিবারেও ড্রাইভার, মালি, পরিচারক বা পরিবারে বেড়াতে আসা নিকট আত্মীয়দের দ্বারাও শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সন্তান কোথায় যায়, ঘরের বাইরে কাদের সঙ্গে মেলামেশা করে, সে সম্পর্কে অবশ্যই ভালভাবে খোঁজ খবর রাখতে হবে। কর্মজীবী বাবা-মায়ের উচিত ঘরে ফিরে, শিশুদের সারাদিনের কর্মকাণ্ডের খুঁটিনাটি জেনে নেওয়া। অবশ্য এ জন্য বাবা-মায়ের উচিত ছোটবেলা থেকে শিশুর সত্য প্রকাশে সংকোচ দূর করা।

ব্যস্ত কর্মজীবী মা হয়তো সন্তানের সঙ্গে একান্তে বন্ধুত্বপূর্ণ সময় কাটাতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই রাতের খাবার টেবিলে সন্তানকে নিজে হাতে খাওয়ানোর সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দিনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনে নেওয়া। একান্তই যদি সময় না হয়, অন্তত সপ্তাহে একটা দিন সন্তানের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানো উচিত বাবা-মার। এ সময় তাদের কাছ থেকে তাদের অভিযোগের বিষয়বস্তু জেনে নিতে হবে। অথবা কোন এক ব্যক্তি সম্পর্কে যদি বেশি উৎসাহী হতে দেখা যায় শিশুকে বা তার কথা বেশি বেশি বলে, তখন অবশ্যই বাবা-মায়ের উচিত সেই ব্যক্তি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া।

শিশু যদি কোনভাবে যৌনতায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাদের আচার-আচরণগত কিছু পরিবর্তন চলে আসে। এসব ক্ষেত্রে শিশু একা থাকতে ভালবাসে, পরিবারের অন্য সদস্যদের এড়িয়ে চলে, খাওয়া বা ঘুম কমে যায় তার। এমন বিশেষ কিছু লক্ষ্য করলে অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে অভিভাবককে। বর্তমান সময়ে করোনা পরিস্থিতিতে স্কুলের ক্লাসগুলি বিশেষ পদ্ধতিতে ইন্টারনেটে নেওয়া হচ্ছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাবা-মা’কে সন্তানের হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের মতো ডিভাইজ দিতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সহজেই শিশু ডিভাইজ এবং ইন্টারনেট পেয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট ওপেন করা মাত্র অনাকাঙ্ক্ষিত ভিডিও চলে আসে। সে ক্ষেত্রে সন্তান সেটি ক্লিক করেছে কি না বা সেটির প্রতি আসক্ত হচেছ কি না, তা অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করতে হবে অভিভাবককে।

সম্ভব হলে শিশুকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভিডিওর কুফল সম্পর্কে বলতে হবে, যাতে সে এসব ভিডিও চলে এলেও ক্লিক না করে এড়িয়ে যায়। যদি তাকে সরাসরি নিষেধ করা হয়, তাহলে সে তা লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করতে পারে। এজন্য এ বিষয়গুলোর কুফল সম্পর্কে শিশুকে বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন। এছাড়া শিশুদের বিভিন্ন ভিডিও দেখিয়ে অনেকেই তাদের যৌন লালসার শিকারে পরিণত করতে পারে। কারণ ইদানিং শিশুকেন্দ্রিক যৌন পর্যটনে এক বিরাট জায়গা জুড়ে অপরাধের সহযোগী হিসেবে রয়েছে ‘ডিভাইজ বাহন’।

সামজে নানা কারণে অস্থিরতা বাড়ছে। পারিবারিক বন্ধন দিনে দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারে বাস করা শিশুরা আত্মীয়-স্বজনের মর্মার্থ জানে না এ সময়ের শিশুরা। সেই সাথে মানুষও দিনে দিনে আত্মীয়-স্বজন বিমুখ হয়ে পড়ছে। যোগাযোগ না থাকার কারণে কাছের আত্মীয়রা হয়ে যাচ্ছে দূরের মানুষ। বিভিন্ন কারণে এ সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতা দূর করা যাচ্ছে না। অনেক সময় বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নিপীড়কের রাজনৈতিক প্রভাব, আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, মাদক, পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা, সামাজিক অস্থিরতা, বিকৃত মানসিকতা শিশুদের নিগৃহীত আর নিপীড়িত করছে প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশ সরকার ধর্ষণ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে। ২০২০ সালে ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশে সই করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ইত্যাদি প্রসঙ্গে ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এতদিন ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা আহত হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থদন্ড বিধানও ছিল। এই আইনের পরিবর্তন এনে ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। সংশোধিত এ আইনে অর্থদন্ড বিধানও বলবৎ রয়েছে।

শিশুর যৌন নিপীড়ন ঠেকাতে সরকারের আইনের পাশাপাশি শিশুদের সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন পারিবারিক জনসচেতনতা। বর্তমান সময়ে মানুষের মানবিক গুণাবলী লোপ পাচ্ছে। মানবিক গুণাবলীর চর্চা প্রয়োজন। তাছাড়া, ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় সাধারণ মানুষ তার অপপ্রয়োগ ঘটাচ্ছে। এ সাথে শিশুদের নিজেদের রক্ষায় তাদের আত্মরক্ষার কৌশল শিখানো প্রতিটি অভিভাবকের দায়িত্ব। গণমাধ্যমগুলি এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের সকলের সম্মিলিত এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা আমাদের শিশুদের নিশ্চয়ই একটি নিরাপদ এবং সুন্দর সমাজ উপহার দিবে, মুজিব বর্ষে এই হোক আমাদের স্বপ্ন এবং অঙ্গীকার। জয় হোক মানবতার, জয় হোক আমাদের শিশুদের।

লেখক : সাংবাদিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password