যে ভুলে ইতালিতে করোনার মহামারি

যে ভুলে ইতালিতে করোনার মহামারি
MostPlay

নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) মোকাবেলায় ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে উদ্যোগ নিয়েও আজ একটি ভুলের মাসুল গুনছে ইতালি। 

 

ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে করোনা ধরা পড়ার পর জানুয়ারি মাসে সংক্রমণের প্রথম দিকের ঘটনাগুলো ইতালি সফলভাবে মোকাবেলা করেছিল। ওই সময় ধরা পড়া রোগীরা কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছিলো।

তুরস্কের রাষ্ট্রীয় এজেন্সি আনাদোলুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তবে দেশটির রাজধানী মিলান থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের কডোনো শহরের করোনা আক্রান্ত এক বাসিন্দা হাসপাতালে ভর্তির পর পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর ফলে ওই হাসপাতালের অন্যান্য রোগী ও কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে করোনা। আর সেখান থেকেই পুরো ইতালিতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা এখন মহামারি রূপ নিয়েছে।

তুরস্কের ইস্তাম্বুলের টুয়েন্টিনাইট মেইজ ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মিকেলাঞ্জেলে গুইদা বার্তা সংস্থা আনাদুলুকে বলেছেন, করোনার প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ইতালিই উইরোপের প্রথম দেশ যারা কিনা চীনের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়। ইউরোপে তারাই প্রথম বিমানবন্দরগুলোতেই করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ‘থার্মাল ক্যামেরা’ বসায়। ওই সময় ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুজেপ্পে কোন্তে দাবি করেছিলেন, করোনা প্রতিরোধে ইতালির নেওয়া ব্যবস্থা পুরো ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী।

তবে ইতালির অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে চীনের সঙ্গে ফ্লাইট স্থগিত করার আগে থেকেই চীন বা করোনা আক্রান্ত অন্য যেকোনো দেশ থেকে কেউ এলে তাদের ‘হোম কোয়ারেন্টিনে’ রাখার এবং চিকিৎসাকর্মীদের দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি।

গত ২৩ জানুয়ারি চীনের হুবেই প্রদেশের দুজন পর্যটক ইতালির মিলান বিমানবন্দর দিয়ে প্রবেশের কিছুদিন পরই রোমে গিয়ে অসুস্থ হন। তাদের মধ্যে করোনা ধরা পড়ে। ৬ ফেব্রুয়ারি চীনের উহান থেকে দেশে ফেরেন এক ইতালীয় নাগরিক। ওই তিনজনই ইতালিতে ধরা পড়া প্রথম করোনা রোগী। তবে দেশটিতে করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় ২২ ফেব্রুয়ারি। ওই সময় অবশ্য করোনা সংক্রমিত রোগীরা সুস্থ হওয়ার পরই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান।

কডোনো শহরের যে রোগী থেকে সারাদেশে করোনায় ব্যাপক আকারে ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে ওই রোগী প্রথমে সামান্য অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে যান। তার পারিবারিক চিকিৎসক হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে বাড়ি পাঠান। দুদিন পর শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সমস্যা দেখা দিলে ওই রোগী আবার হাসপাতালে যান। কিন্তু তখনো প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর ফলে ওই রোগীর কাছ থেকে করোনাভাইরাস অন্য রোগী ও হাসপাতালের কর্মীসহ পুরো ১৬ হাজার বাসিন্দার পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

জানা গেছে, কডোনো শহরের ওই রোগী চীন ফেরত এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু তার ওই বন্ধু করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না। ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা গেছে, ওই রোগীর ভাইরাসের উৎস জার্মানির মিউনিখ বা ফিনল্যান্ড হতে পারে। কিন্তু কিভাবে ওই রোগীর করোনায় আক্রান্ত হলেন তা জানা যায়নি।

তবে অধ্যাপক মিকেলাঞ্জেলে গুইদা এক্ষেত্রে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই বলেই মনে করেন। তার মতে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির কডোনো শহরের সঙ্গে বড় শহরগুলোর যোগাযোগ আছে। পড়ালেখাসহ বিভিন্ন কাজে কডোনো ও আশপাশের শহরগুলোতে যাতায়াতের জন্য লোকজন গণপরিবহন ব্যবহার করে। সেখান থেকে খুব সহজেই পুরো ইতালিতে ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস।

দেশটিতে প্রথম মৃত্যুর পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইতালি সরকার ১১টি শহরকে ‘রেডজোন’ ঘোষণা করে। একইসঙ্গে সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়। পুরো এলাকাকে ‘কোয়ারেন্টিন’ করা হয়। তারপরেও মার্চ মাসের শুরু থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। ৪ মার্চ ইতালি সরকার দেশজুড়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এরপর যখন সরকার বুঝতে পারে করোনাভাইরাস আর প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না, তখন পুরো দেশের ছয় কোটিরও বেশি বাসিন্দাকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের নির্দেশ দেয়।

করোনা প্রথম ধরা পড়া দেশ চীন থেকে ভৌগলিকভাবে ইতালির এত দূরে অবস্থান হলেও কেনো দেশটিতে এমন মহামারি আকারে ছড়ালে? এক্ষেত্রে চীনা পর্যটকদের উচ্চ সংখ্যাই বড় সন্দেহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর ৩১ লাখ চীনা পর্যটক ইতালি সফর করেছে। তবে ইতালিতে মৃত্যুহার এতো বেশি হওয়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা কারণ হিসেবে দেখছেন, সেখানকার প্রবীণ জনসংখ্যার হারকে। ডেমোগ্রাফিক সায়েন্স জার্নালের এক নিবন্ধে অক্সফোর্ডের গবেষকরা লিখেছেন, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিরা অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিতে আছেন। ইতালির মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password