মৃত্যুর এত বছর পরও এতটুকুও দূরে সরে যান নি হুমায়ুন আহমেদ

মৃত্যুর এত বছর পরও এতটুকুও দূরে সরে যান নি হুমায়ুন আহমেদ
MostPlay

বাংলা সাহিত্যের জাদুকর, সহজ কথার কারিগর হুমায়ুন আহমেদের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। নিউইয়র্কে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে এগারোটায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পৃথিবীর মানুষদের সাহিত্যের জাদু দেখানো থেকে বিদায় নিয়ে পাড়ি জমান পরপারে৷

মানুষকে মুগ্ধ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন বাংলা সাহিত্যের জাদুকর হুমায়ুন আহমেদ। একদিকে হিমু অন্যদিকে মিসির আলী অতঃপর আবার শুভ্র। এই তিন ঘরানার তিন চরিত্রের স্রস্টা নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ৷ তার লেখার মতো বলা কথাগুলোও ভক্ত, পাঠকের জন্য ছিল বিশেষ কিছু। সহজ কথাতো বটেই, খুব কঠিন কথাও সহজে বলতে জানতেন তিনি। খুব কঠিন একটা গল্পকে এত সহজ ভাষায় উপস্থাপন করতেন সবার কাছে মনে হতো গল্পটা বোধহয় আমার, আমাদের আশেপাশের কোন একজনের৷ প্রচন্ড রসবোধ আর মানবচরিত্র চিত্রনে হুমায়ুন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের মাস্টার। গল্প, উপন্যাস, টেলিভিশন নাটক অথবা চলচ্চিত্র- যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন।

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। তার ডাক নাম ছিলো কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান ছিলেন তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা ছিলেন গৃহিণী।

বাংলাদেশের ইতিহাসে হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর। হুমায়ূন আহমেদ প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে (১৯৭২) লিখে সাড়া ফেলে দেন। এরপর যা-ই লিখেছেন পাঠক সাগ্রহে লুফে নিয়েছে। একুশে বইমেলায় লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে পাঠক তার বই কিনেছে, প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থেকেছে। প্রকাশকেরাও তার পাণ্ডুলিপি পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। একটা সময় ছিল, যখন তার লেখা ছাড়া ঈদসংখ্যা পূর্ণতা পেত না। পাঠকেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন হুমায়ূন আহমেদ এরপর কী লিখেছেন পড়ার জন্য। বাংলা সাহিত্যে এমন আর কবে দেখা গেছে!

টিভি নাট্যকার হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় নির্মাণ করেন প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’। এ নাটকটি তাকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। এছাড়াও তার হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং সৃষ্টির অনবদ্য ইতিহাস ‘অয়োময়’ ছিলো বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। এছাড়াও তিনি নির্মাণ করেন নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। হুমায়ূন আহমেদের নাটক টেলিভিশনে প্রচারিত হবে- এটা জানার পর শহরের রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে!

আবার যখন তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তখনও দর্শক আগ্রহ দেখিয়েছেন। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’ ও ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিগুলো দেখার জন্য সিনেমা হলগুলোতে দর্শকদের লম্বা লাইন লক্ষ করা গেছে৷ নিয়মিত না হলেও মাঝেই মাঝেই তিনি নাটক বা সিনেমার জন্য আবার গানও লিখেছেন, আবার সুরও করেছেন, তা সমাদৃতও হয়েছে। ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’, ‘এক যে ছিল সোনার কন্যা’, ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা বেড়া ভাঙা চালার ফাঁকে’, ‘চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’- হুমায়ূন আহমেদের লেখা এই গানগুলো শ্রোতাদের পছন্দের গানের প্রথম সারিতেই দেখা যায়।

হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদিও স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) লাভ করেন।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্ত হঠাৎ করে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হুমায়ূন আহমেদের শরীরে ধরা পড়ে মরনব্যাধি ক্যান্সার। এরপর উন্নত চিকিৎসার ড্রয়োজনে তাকে যেতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। চিকিৎসার মাঝপথে একবার দেশে এসেছিলেন তিনি। তার পরিচালিত সর্বশেষ সিনেমা "ঘেটুপুত্র কমলার‍" প্রিমিয়ার শোতে উপস্থিত ছিলেন। তারপর চিকিৎসার জন্য আবার চলে যান অ্যামেরিকায়। জীবিত অবস্থায় আর ফেরা হয়নি তার। নিউইয়র্কে ২০১২ সালের ১৬ জুলাই তিনি চলে যান লাইফ সাপোর্টে। সে অবস্থাতেই ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে এগারোটায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেশে ফিরেছেন লাশ হয়ে।

আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এ লেখকের মৃত্যুতে পুরো দেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছিলো, যা আজও তার লক্ষ-কোটি ভক্তদের অন্তর সে শোক ধারণ করে আছে। শহীদ মিনারে লাখো মানুষের আঁখি জলে ভেজা পুষ্পতে সিক্ত হন হিমু, মিসর আলী ও শুভ্রর স্রস্টা হুমায়ূন আহমেদ। এর পরের দিন তাকে সমাহিত করা হয় তার নিজ হাতে গড়ে তোলা মমতার চাদরে ঢাকা নুহাশ পল্লীর লিচু-তলায়। সেখানেই এখন শায়িত আছেন নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।বর্ষা ও জোছনা খুব প্রিয় ছিল হুমায়ুন আহমেদের কাছে। তার খুব ইচ্ছা ছিল চাদনি পসর রাতে যেন তার মৃত্যু হয়। তার ইচ্ছার কথাটি তার লেখা গানেও প্রকাশ করেছিলেন তিনি কিন্ত সৃষ্টিকর্তার কি নিদারুণ খেলা যে ব্যাক্তিটি জোসনা এত ভালবাসতেন তার মৃত্যু হয়েছিল ঘোর অন্ধকার রাতে। সেই রাতে চাদের দেখা পাওয়া যায়নি তবে সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল৷ এমিনকি যখন তাকে কবরে শায়িত করা হচ্ছিল ঠিক তখনও বৃষ্টি হচ্ছিল৷

হুমায়ুন আহমেদ দীর্ঘ নয় বছর আগে সবাইকে ছেড়ে গেলেও আজও তার জনপ্রিয়তায় কোন ভাটা পড়েনি। যার প্রমান প্রতি বইমেলায় মিলে। এখনো বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের বই কিনতে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। তাঁর বইয়ের বিক্রি এখনও বেশি। এখনও তার জন্মদিনে তার ভক্তরা হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে হিমু দিবস পালন করে। মৃত্যুর পর এতটুকুও দূরে সরে যান নি তিনি। নতুন প্রজন্মের কাছেও সমান জনপ্রিয় তিনি। এখনও তার বই পড়ে পাঠকরা নিজেকে হিমু মনে করে, মিসির আলীর মতো ভাবতে শুরু করে৷ তার মারা যাওয়ার পর তিনি সময়ের সাথে মিলিয়ে যাননি বরং যতই দিন যাচ্ছে তাঁর লেখা আরও বহুমাত্রায় রঙিন হয়ে উঠছে। হ্যাঁ এটাই হুমায়ূন আহমেদের জাদু। যেই জাদু থেকে চাইলেও বের হওয়া যায়না।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password