অস্ত্র-বাণিজ্য: বৃহৎ ক্রেতা থেকে যেভাবে প্রধান রপ্তানিকারকে পরিণত হলো চীন

অস্ত্র-বাণিজ্য: বৃহৎ ক্রেতা থেকে যেভাবে প্রধান রপ্তানিকারকে পরিণত হলো চীন
MostPlay

সিপ্রির তথ্যানুসারে, ২০১৬-২০২০ মেয়াদে চীনের মোট অস্ত্র রপ্তানির ৩৮ শতাংশ গেছে পাকিস্তানে, ১৭ শতাংশ বাংলাদেশে এবং ৮.২ শতাংশ আলজেরিয়ায়। একইসময়ে বেড়েছে চীনের রপ্তানি উৎস দেশের সংখ্যা ক'দিন আগেই পালিত হলো চীনের শাসকদল চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির শততম বার্ষিকী। সেখানে প্রদর্শিত হয়; গভীর সাগরে চলাচলে সক্ষম ড্রোন, ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাঙ্ক ও জঙ্গিবিমান।

এসব অস্ত্র চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তিকে তুলে ধরছে। দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র বাণিজ্যের অন্যান্য নেতৃস্থানীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি উভয় দিক থেকেই এক প্রতিযোগিতা করেছে চীন। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির স্থানীয় সমরাস্ত্র শিল্পের বিকাশের লক্ষ্য থেকে বেইজিং এ উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে; চীন বিদেশি কোন উৎসের কাছ থেকে অস্ত্র ও প্রযুক্তি আমদানি করে এবং নিজেদের উৎপাদিত অস্ত্র কোথায় কোথায় রপ্তানি করছে? চীনে প্রধান অস্ত্র রপ্তানিকারক: স্থানীয়ভাবে অস্ত্র শিল্পের বিকাশে মনোযোগী হলেও চীনে বিশাল অঙ্কের অস্ত্র রপ্তানি করে রাশিয়া।

১৯৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর থেকে দুই দেশের সমরাস্ত্র বাণিজ্যের এ ভিত্তি আরও দৃঢ়তা লাভ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের ওই সময়ে বেইজিং নিজ সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়। বিশেষ করে, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ ও তৃতীয় তাইওয়ান প্রণালী সংকটের পর চীনা গণমুক্তি ফৌজের (সামরিক বাহিনী) বহুগুণ পিছিয়ে থাকার দিকটি উপলদ্ধি করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আধুনিকায়নে প্রথমে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর ভরসা করেছিল চীন, কিন্তু ১৯৮৯ সালের তিয়ানমেন স্কয়ারে রক্তাক্ত দমনাভিজানের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফলে চীন বাধ্য হয় প্রতিবেশী রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে।

আর রাশিয়াও কার্যকর বিকল্প উৎস হয়ে ওঠে। না হওয়ার কারণও ছিল না। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দেশটির সমরাস্ত্র শিল্পে তখন নাজেহাল দশা। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করে মস্কো এ বিপর্যয় সামাল দেওয়ার সুযোগ পায়। ১৯৯২ সালে হয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চুক্তি। ওই বছর রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক সুখই-২৭ যুদ্ধবিমান ক্রয় করা শুরু করে চীন। সেই সহযোগিতার ধারা এখনও অক্ষুণ্ণ।

গেল ডিসেম্বরে স্টকহোম পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল নাগাদ চীনের আমদানিকৃত অস্ত্রের ৭৭ শতাংশই এসেছে রাশিয়া থেকে। চীনা বিমান বাহিনীর একটি সুখই-৩৫ যুদ্ধবিমান।  একই সময়ে রাশিয়ার মোট অস্ত্র রপ্তানির ১৮ শতাংশই কেনে চীন। ফলে ভারতের পর রুশ অস্ত্র ক্রয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে দেশটি। ২০১৬-২০২০ মেয়াদে চীনে রাশিয়ার প্রধান প্রধান অস্ত্র রপ্তানি পূর্ববর্তী ৫ বছরের তুলনায় ৪৯ শতাংশ বাড়ে বলে জানায় বৈশ্বিক সামরিক শক্তি নিরূপণের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থা- সিপ্রি। সামরিক সহায়তা ও কৌশলগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মস্কো ও বেইজিং প্রায়শই একযোগে কাজ করে।

যৌথ মহড়া ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা সামরিক সম্পর্ক জোরদারের প্রতিশ্রুতি দিলেও- এটি স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ের মতো সামরিক ও রাজনৈতিক জোট নয় বলে গত জুনে দেওয়ার এক যৌথ বিবৃতিতে দাবি করা হয়। আর কোন দেশ থেকে চীন অস্ত্র আমদানি করে? ইউরোপ মহাদেশের কয়েকটি দেশ চীনের সামরিক বাহিনীর অস্ত্রসজ্জা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। যেমন রাশিয়ার পর ২০১৬-২০২০ মেয়াদে চীনের দ্বিতীয় বৃহৎ অস্ত্র সরবরাহক ছিল ফ্রান্স (৯.৭ শতাংশ) ও ইউক্রেন (৬.৩ শতাংশ)। গত ৫ বছরে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা ছিল চীন, দেশটির মোট সমরাস্ত্র বিক্রির ৩৬ শতাংশ কিনেছে বেইজিং। সিপ্রির প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতি বছর গড়ে ৮ থেকে ৯ কোটি ডলারের অস্ত্র ইউক্রেন চীনে রপ্তানি করেছে। সুইজারল্যান্ডের সামরিক রপ্তানিরও দ্বিতীয় বৃহৎ ক্রেতা চীন। আলোচিত সময়ে বেইজিং সুইজারল্যান্ডের মোট রপ্তানির ১৩ শতাংশ কিনেছে। এছাড়া, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের সমরাস্ত্র কিনে থাকে।

সিপ্রির বিশ্লেষণ অনুসারে, ২০২০ সালে চীন ছিল বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অস্ত্র আমদানিকারক। চীন যে ধরনের অস্ত্র আমদানি করে: এক সময় এভিয়েশন শিল্পে চীনের অগ্রগতি যথেষ্ট ছিল না। তাই রাশিয়া-চীন অস্ত্র বাণিজ্যের ইতিহাসে যুদ্ধবিমান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয়ের পরিমাণই বেশি। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের- বার্ষিক চায়না মিলিটারি পাওয়ার রিপোর্ট অনুসারে, চীন ২০১৬ সালে রাশিয়া থেকে ২৪টি সুখই-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনে। এছাড়া, ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এপর্যন্ত রাশিয়ার তৈরি ১২টি কিলো শ্রেণির অ্যাটাক সাবমেরিন কিনেছে।

এছাড়া, রাশিয়ার তৈরি জাহাজ প্রতিরক্ষা কামান একে-১৭৬, সেনা পরিবহন ও প্রয়োজনে গানশিপ হিসেবে ব্যবহার করা যায় এমন এমআই৮এমটি/ মি-১৭ হেলিকপ্টার কিনেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানির সিংহভাগই ছিল চীনে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত যুদ্ধবিমানের জন্য এএল-৩১ ও ডি-৩০ টার্বোফ্যান জেট ইঞ্জিন। ১৯৮০'র দশকের শেষ দিক থেকে এপর্যন্ত চীনে এএস৫৬৫এস প্যান্থারের মতো শত শত সামরিক হেলিকপটার সরবরাহ করেছে ফ্রান্স। জার্মানি থেকে কিনেছে হাজার হাজার ডিজেল ইঞ্জিন, এছাড়া ইউক্রেন ও যুক্তরাজ্য থেকে কিনেছে গ্যাস টার্বাইন ইঞ্জিন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদন অনুসারে, চীনের কাছে অস্ত্র বিক্রি জোরালো করেছে রাশিয়া। এর আওতায় বেইজিংয়ের কাছে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সভরমেনি ক্লাস ডেস্ট্রয়ার ও অত্যাধুনিক ক্রুজ মিসাইল বিক্রি করেছে মস্কো।

একইসঙ্গে চীন কি বৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক? বিদেশি অস্ত্রের উপর নির্ভরতা হ্রাস করেছে চীন এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজস্ব সামরিক উত্পাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে। সিপ্রির গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ সমরাস্ত্র রপ্তানিকারক হয়ে ওঠে চীন। সুইডিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্কটি জানায়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল মেয়াদে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারক ছিল চীন। ইতঃপূর্বে, নিজ সমরাস্ত্র শিল্পের উপকরণ, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তার জন্য রাশিয়ার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল হলেও; বর্তমানে স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদনের অগ্রগতিতে রাশিয়ার সমান বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশটিকে পেছনে ফেলেছে চীন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গোয়েন্দা বিভাগ কংগ্রেসকে জানিয়েছে যে, চীনের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নতুন গতি লাভ করেছে, সে তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে রাশিয়া। চীনের অগ্রগতির প্রধান কারণ বিশাল অংকের সামরিক বাজেট। সিপ্রির মতে, গত ২৬ বছর ধরে চীনের সামরিক বরাদ্দ নিরবিচ্ছিন্নভাবে বেড়েছে। ২০২০ সালে চীনের অনুমিত সামরিক ব্যয় ছিল ২৫ হাজার ২০০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১.৯ শতাংশ বেশি। সে তুলনায় ২০২০ সালে রাশিয়ার সামরিক ব্যয় ছিল মাত্র ৬ হাজার ১৭০ কোটি ডলার। চীন কোথায় অস্ত্র রপ্তানি করে? ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের রণসজ্জা শক্তিশালী করার ঐতিহাসিক প্রবণতা রয়েছে চীনের। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালের পর থেকে চীনা অস্ত্রের প্রাথমিক ক্রেতা হয়ে ওঠে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মিয়ানমার। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে চীন। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এসব দেশ চীনের মোট অস্ত্র রপ্তানির ১৯.১ শতাংশ কিনেছিল।

সিপ্রির মতে, ২০১৬-২০২০ মেয়াদে চীনের মোট অস্ত্র রপ্তানির ৩৮ শতাংশ গেছে পাকিস্তানে, ১৭ শতাংশ বাংলাদেশে এবং ৮.২ শতাংশ আলজেরিয়ায়। একইসময়ে বেড়েছে চীনের রপ্তানিযোগ্য দেশের সংখ্যা। বিশ্বের ৫৩টির বেশি দেশ এখন চীনা অস্ত্র কিনছে। তাছাড়া, ২০১১ সাল থেকে মনুষ্যহীন বিমান বা ড্রোন রপ্তানিতে শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে চীন। ইতঃপূর্বে, এই বাজারটি কেবল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েলের মতো রাষ্ট্রের দখলে ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনিসিলভানিয়া ও টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটির এক যৌথ গবেষণা অনুসারে, ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ ১৮টি দেশ অস্ত্র বহনে সক্ষম ড্রোন কিনেছে। এদের মধ্যে; সৌদি আরব, মিশর ও উজবেকিস্তানসহ ১১টি দেশ চীন থেকে তাদের ড্রোন সংগ্রহ করে। একইসময়ে শুধুমাত্র ফ্রান্সের কাছে ড্রোন সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া, ২০২২-২০২৮ সাল নাগাদ পাকিস্তানের কাছে আটটি ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন সরবরাহ করবে চীন। মিত্র দেশ দুটি যৌথভাবে জেএফ-১৭ থান্ডারের মতো যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, মিসাইল বোট, ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সমরাস্ত্র উৎপাদন করে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password