ইসলামে নারী শিক্ষা

ইসলামে নারী শিক্ষা
MostPlay

ইসলামের মহান পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদের (সা.) ওপর অবতীর্ণ অহির প্রথম শব্দটিই ছিল 'ইকস্ফরা' অর্থাৎ পড়ো। পড়ার মাধ্যমেই অর্জিত হয় শিক্ষা আর সেই শিক্ষার সোপান বেয়েই মানুষরা লাভ করে থাকে ইহজাগতিক ও পারলৌকিক আবশ্যকীয় জ্ঞান; যা মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য। জ্ঞানের কোরআনি পরিভাষাই হচ্ছে 'ইলম'- রাসুলে কারিমের (সা.) ভাষায় যা অর্জন করা প্রতিটি নর-নারীর জন্যই ফরজ তথা অবশ্য কর্তব্য হিসেবে পালনীয়। শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম কখনোই নর-নারীভেদে ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করেনি, বরং এটি সবার জন্যই অবধারিত ঘোষণা করা হয়েছে। জ্ঞানের অপর নাম আলো আর আলোকের কাজই হলো অন্ধকার বিদূরিত করা। সমাজদেহে নারী-পুরুষ উভয়েরই বাস। তাই সমাজে বিদ্যমান অজ্ঞতার অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে দূরীকরণের লক্ষ্যে নারী ও পুরুষ সবাইকে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করতে হবে।

নারী হচ্ছে সম্মান, মর্যাদা ও মাতৃত্বের প্রতীক। বলা হয়ে থাকে, 'হেযনুল উম্মাহাতে হিয়াল মাদরাসাতিল বানিনা ওয়াল বানাত' অর্থাৎ মাতৃক্রোড় প্রতিটা শিশুর জন্য প্রথম বিদ্যায়তন; যেখানে ছেলে কি মেয়ে সবারই প্রথম বুনিয়াদি তালিমটুকু গ্রহণ করতে হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে মাতৃক্রোড়ের অধিকারী নারীর জন্য শিক্ষা ও জ্ঞানের ধারক হওয়া আবশ্যক; নচেৎ প্রতিটি নবজাতক বাচ্ছার প্রথম এই শিক্ষালয়ে কী পাঠ তারা গ্রহণ করবে? সন্তানরা শৈশব ও কৈশোরে বেশিরভাগ সময় মায়ের তত্ত্বাবধানেই লালিত-পালিত হয় বিধায় একজন শিক্ষিত, জ্ঞানী মা-ই পারেন তার সন্তানকে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে। এদিক থেকে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। পবিত্র কোরআন ও মহানবীর (সা.) হাদিসে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের যত তাগিদ এসেছে তার সবকিছুই নর-নারী নির্বিশেষে, কোথাও নারীকে অপেক্ষাকৃত কম শিখতে বা কম জানতে-পড়তে বলা হয়নি। একজন নারী তার শিক্ষার মধ্য দিয়েই তিনি আদর্শ কন্যা, আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা- সর্বোপরি আদর্শ নারী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করবেন; এটিই নারী শিক্ষার লক্ষ্য। ইসলামের ইতিহাসে হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.), হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.), হজরত ফাতেমাতুজ জাহরা (রা.), হজরত হাফসা (রা.), হজরত উম্মে কুলসুম (রা.), প্রমুখের মতো মহীয়সী নারী শিক্ষা ও জ্ঞানের নানা শাখায় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

মহান আল্লাহর বাণী- নশ্বর পৃথিবীতে কোনো জিনিসই আল্লাহতায়ালা অনর্থক সৃষ্টি করেননি। তাই তিনি তাঁর সব সৃষ্টি ও সৃষ্ট জগৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা করতে বলেছেন। উন্নত চিন্তা আর সৃষ্টিশীল গবেষণার জন্য স্বল্প পড়াশোনা যথেষ্ট নয়, এ জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ জরুরি; যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অর্জন করবে। মহান রব আরও বলেন- আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁকে প্রকৃত অর্থে ভয় করেন। আল্লাহর বাণী- 'ইত্তাকুল্লাহ' আল্লাহকে ভয় করো, এই নির্দেশনা নারী-পুরুষ সবার প্রতি; নারী যদি জ্ঞানার্জন না করে, তাহলে কীভাবে সে আল্লাহকে প্রকৃতপক্ষে ভয়ের নীতি গ্রহণ করবে? আল্লাহ বলেছেন- তোমাদের রাসুল যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তা তোমরা মেনে চলো আর যেসব বিষয়ে তিনি নিষেধ করেছেন, সেসব থেকে নিজেদের বিরত রেখো। নারী যদি পর্যাপ্ত বা প্রয়োজনীয় পড়াশোনা না করে, তবে সে তার প্রতি নির্দেশিত মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সব নির্দেশনা কীভাবে জানবে ও মানবে? পবিত্র কোরআন শিক্ষার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ হাদিস- তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম, যে নিজে কোরআন শিখবে এবং অন্যদের শিক্ষা দেবে। একজন নারীর পড়াশোনা আর জ্ঞান না থাকলে কীভাবে সে নিজে কোরআন পড়বে আর কীভাবেই-বা সে অন্যদের শিক্ষা দেওয়ার মতো কাজটি সম্পন্ন করবে? তাহলে কি একজন নারী রাসুলের (সা.) কথামতো মানুষ হিসেবে উত্তম হওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে পারবে না? ইসলামের দৃষ্টিতে একজন নারী নিজেকে উত্তম ব্যক্তিত্বে পরিণত করার সব অধিকার সংরক্ষণ করেন।

ইরশাদ হচ্ছে- পৃথিবীতে মানব আর জিনের সৃষ্টি শুধু আমার ইবাদতের জন্যই। আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষের অগ্রাধিকার কর্মের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে 'ইবাদত'। মহান প্রভুর উপাসনা, তাঁর বন্দেগি, সব আদেশ-নিষেধের ফরমাবরদারি করাই বান্দার কাজ। ইবাদত একটি বিস্তৃত পরিসরের বিষয়, এক সামষ্টিক কর্মপ্রক্রিয়ার নাম। স্রষ্টার ইবাদত সম্বন্ধে জানতে হলে প্রথমেই মানুষের জ্ঞানার্জন অত্যাবশ্যক। শিক্ষা ও জ্ঞানের মাহাত্ম্য অর্জন ব্যতিরেকে ইবাদতের মর্মার্থ অনুধাবন কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে, মহান আল্লাহ ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত হিসেবে জ্ঞানার্জনকে সুনির্দিষ্ট উপকরণ হিসেবে ঘোষণা করেছেন; ইবাদতের পূর্বেই জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। নারীদের সব ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য তাদের জ্ঞানার্জনের রাস্তায় চলতে হবে; নচেৎ তাদের কৃত সব ইবাদত অজ্ঞতার আঁধার-গলিতে নিপতিত হবে। বুখারি, মুসলিম ও তিরমিজি শরিফের হাদিসমতে, একদা রাসুলের কাছে এক নারী এসে কোনো বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করল। বিদায়ের সময় রাসুল (সা.) তাকে বললেন, তোমার যদি এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে জানতে ইচ্ছা হয় বা প্রয়োজন পড়ে, তবে আবারও এসে জেনে নিও। নারী বললেন, যদি আপনাকে না পাই অথবা আপনি যদি দুনিয়া হতে বিদায় হয়ে যান, তবে আমরা কী করব? রাসুল (সা.) জবাবে বললেন, তবে তা আবু বকরের (রা.) কাছ থেকে জেনে নিও। তারপরও শিক্ষা ও জ্ঞানের ধারা রহিত করা যাবে না। অন্য একসময় নারীরা এসে রাসুলকে বলেন, আপনি সবসময় পুরুষদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন, আমাদের জন্য তাহলে একটা দিন নির্দিষ্ট করুন, যাতে আমরা জ্ঞান আহরণ করতে পারি। নবীজি সে অনুযায়ী তাঁদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ হাদিসদ্বয়ের আলোকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, রাসুল (সা.) নারীদের শিক্ষা দিতেন এবং তাঁর অবর্তমানেও যেন নারী শিক্ষার এ ধারা অব্যাহত থাকে, সে জন্যও তিনি নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সে যুগে নারীরা শুধু নিজেরা পড়াশোনা করেছেন তাই নয়, অন্যদের শিক্ষাও দিয়েছেন। হজরত আয়েশা (রা.) ছিলেন অজস্র মানুষের শিক্ষক; চার খলিফাসহ অসংখ্য সাহাবি তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন। ইসলামের বিধান হলো, নারীরা শিক্ষা ও জ্ঞানের যে কোনো স্তরেই অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে পারবেন এবং অর্জিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মিশেলে অন্যদের শিক্ষাদানও করতে পারবেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন- 'তোমাদের গৃহে মহান আল্লাহর যে বাণী ও হেকমত পঠিত ও পরিবেশিত হয়, তা তোমরা স্মরণ ও প্রচার করো (সুরা আহযাব, ৩৪)।

মানবেতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট যুগ ছিল আরবের আইয়ামে জাহেলিয়া। অজ্ঞতা ও মূর্খতার জন্য সেই যুগটি বর্বর, অমানবিক ও নিষ্ঠুরতার সব উপকরণে ঢেকে গিয়েছিল। জেহালতের সেই অন্ধকারাচ্ছন্নতা শুধু শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোকবর্তিকার মাধ্যমেই দূরীভূত হয়েছিল; নারী-পুরুষের সম্মিলিত জ্ঞানের মাধ্যমেই আঁধার মরুর বুকে যে আলোকিত সমাজ নির্মিত হয়েছিল, তা আজও পর্যন্ত সভ্যতার ইতিহাসে সর্বোৎকৃষ্ট যুগ হিসেবে স্বীকৃত।

 

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

লেখক ও গবেষক; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password