তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বাংলাদেশ সফর কেন গুরুত্বপূর্ণ

তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বাংলাদেশ সফর কেন গুরুত্বপূর্ণ

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি বাংলাদেশ আলোচিত হচ্ছিল গত সেপ্টেম্বর থেকে। গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে আগ্রহের কোনো শেষ নেই। আর ইউটিউবারদের উৎসাহের কথা না হয় না-ই বা বললাম। বাংলাদেশে তার গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা ঘোর তুরস্ক বিরোধী মিডিয়াগুলোকেও তুরস্ক এবং এরদোগানকে নিয়ে ইতিবাচক খবর প্রচারে বাধ্য করছে। তার এই ব্যাপক জনপ্রিয়তা তিনি আঁচ করতে না পারলেও বাংলাদেশের মিডিয়া ঠিকই আঁচ করতে পেরেছে।  

মিডিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষও তার জন্য পাগল। কেউ তাকে সুলতান বলছেন! কেউ বা মুসলিম বিশ্বের নেতা! কেউ বা বলছেন মুসলিম বিশ্বের খলিফা। আর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাত করা, কাছ থেকে না পারলেও দূর থেকে তাকে এক পলক দেখার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন হাজার হাজার লোক। এরদোগানের পদধূলি বাংলাদেশের মাটিতে পরা তাদের জন্য দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ  বিষয়। আর তাইতো এরদোগানের বাংলাদেশ সফরেরর বিষয়টি আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার জন্ম দেয়। 

এই সফরের বিষয়টি প্রথম মিডিয়ায় আসে গতবছর সেপ্টেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন তার আঙ্কারা সফরকালে এরদোগানের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাত করেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ পত্র তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কাছে হস্তান্তর করেন।

তখন প্রচার করা হয় যে এরদোগান “আগামী বছর মুজিব বর্ষ সমাপনী অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বা ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশে আসছেন”। বাংলাদেশের পাঠকরা তখন ব্যাপক সাড়া দেয় এ খবরে।

পাঠক সংখ্যা বাড়লে গণমাধ্যমও তখন খবরটিকে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশ থেকে অনেকে আমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চান। আমি তাদেরকে বলি, তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। সুতরাং তার সফরের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত না।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আঙ্কারায় আমার যখন কথা হয় তখনও তিনি জানিয়েছেন যে, এরদোগান বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে তার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।

এক রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে আরেক রাষ্ট্রপ্রধানকে যখন আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রাপক প্রেরকে ধন্যবাদ দেন এবং ওই দেশ ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও একটি অংশ। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরের জন্য শুধু একটু মৌখিক সম্মতি বা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের কারণে ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশই যথেষ্ট নয়।

আমি ঢাকায় আমার সাংবাদিক বন্ধুদের বুঝানোর চেষ্টা করলাম। এ নিয়ে আমার ফেসবুক পেইজেও স্ট্যাটাস দিলাম। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি আকারে বিষয়টি জানানো হয়েছে তাই আমার যুক্তি তাদের কাছে ধোপে টিকলো না।

এক মাস পরে এরদোগানের সফরের বিষয়টি আবার বাংলাদেশের মিডিয়ায় আসে ফলাও হয়ে। দিকে।বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা ওসমান তুরান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের কার্যালয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় পাঠানো উপহারসামগ্রী হস্তান্তরের পরে বিষয়টি আবার জানানো হয়।

মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা আসে যে, ‘এরদোগান বাংলাদেশে আসছেন’।এবার বলা হয় কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ২০২১ সালের গোরার দিকে বাংলাদেশে আয়োজিত ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশে যেতে পারেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। আবার ঢাকার সাংবাদিক পাড়ায় এ নিয়ে হইচই পড়ে যায়।

এরদোগানের সফরে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে? কোন সামরিক চুক্তি হবে কি না? রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে কোন সুরহায় আসবেন কিনা? ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশী মিডিয়া আবার খবর প্রচার করতে সচেষ্ট হয়। অনেকে আবার আমাকেও জিজ্ঞেস করেন।

আমার আবারও সেই একই জবাব, তুরস্কের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি।তারা বললেন ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত সরাসরি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন। আর কি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দরকার আছে? আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই।

বিষয়টি নিয়ে আমারও যে আগ্রহ ছিল না তা কিন্তু নয়। যে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের বাংলাদেশ সফরই আমাদের জন্য সুসংবাদ। বিশেষ করে  সে অতিথি যদি হন এরদোগান, সে রাষ্ট্রপ্রধান যদি হন এমন একটি দেশের যেখানে আমি বসবাস করছি গত ১৫ বছর ধরে।

তখন বিষয়টি নিয়ে তুরস্কের ঢাকাস্থ দূতাবাসে কথা বললাম। তারা জানালেন যে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো কিছুই বলা হয়নি।আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও যোগাযোগ করলাম। তাঁরাও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন সবুজ সংকেত পাননি।

দুদেশের দূতাবাস এবং বাংলাদেশে কর্মরত তুরস্কের বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের কাজের গতিবিধি লক্ষ্য করে আমি নিশ্চিত হলাম যে এরদোগান মার্চ-এপ্রিল তো দূরের কথা খুব শিগগিরই বাংলাদেশে যাচ্ছেন না।

২৬ মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আসবেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। সে অনুষ্ঠানে এরদগানের যাওয়ার সম্ভবনা থাকলে তুরস্ক থেকেও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা ঢাকায় গিয়ে তার বিস্তারিত আলোচনা করে তার সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করতেন; কিন্তু তা হয়নি।  সুতরাং এরদগান ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানে যে যাচ্ছেন না সেটা এখন মোটামুটি নিশ্চিত।

বাকি থাকলো ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিষয়টি। বাংলাদেশে এ সম্মেলনটি গত বছর হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা কয়েকবার পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এ বছরের শুরুতে হওয়ার কথা ছিল তাও পিছিয়ে যায়। এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকার এই সম্মেলনটি এপ্রিলের ৪ তারিখে ভার্চুয়ালি করার সিদ্ধান্ত নেয়।

যেহেতু সম্মেলনটি অনলাইনে হবে সেহেতু ডি-৮ ভুক্ত অন্য দেশের সরকার প্রধানদের মত এরদোগানেরও বাংলাদেশে যাওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।

করোনাভাইরাসের মধ্যে এরদোগান বিদেশ ভ্রমণ অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। শুধুমাত্র আজারবাইজান, কাতার বা তুর্কি সাইপ্রাস ছাড়া অন্য কোথাও যাননি। দেশের ভেতরের অনুষ্ঠানগুলোরও বেশিরভাগই অনলাইনে যোগদান করেন। তাই করোনার বিষয়টিকে মাথায় রেখেই বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে তাড়াতাড়ি কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছে না এরদোগান সরকার।

তবে আঙ্কারা বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক, এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। বাংলাদেশও তুরস্ককে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে কাছে পেতে চায় সবসময়। সেদিক থেকে এরদোগানের বাংলাদেশ সফর হলে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ভারত বলয় থেকে বেরিয়ে চীন-তুরস্ক-পাকিস্তান বলয়ের দিকে ঝুঁকতে চাচ্ছে বাংলাদেশ-এমন একটা কথা চাওড় হয়েছে। এদিক থেকেও এরদোগানের সফর বিভিন্ন মহলের কাছে এরদোগানের সফর নিয়ে কৌতুহল রয়েছে।

সারা বিশ্বে লক্ষ কোটি মুসলিমের প্রাণের নেতা, শতকোটি যুবকের মনে আশার সঞ্চারকারী, মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা এরদোগানের বাংলাদেশ সফর শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্যই না, ওই অঞ্চলের শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, মানুষের জন্য বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সহ আরও অনেক দেশের জন্যও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাই এখন না হলেও অদূর ভবিষ্যতে তার ঢাকা সফর হওয়া উচিত। আর সে সফর অনেক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উম্মুক্ত করবে।

সুত্রঃ যুগান্তর

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password