দেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে

দেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে

প্রাণ-সংহারী করোনাভাইরাসের কারণে দেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অতিমারির আগে যেখানে এ সংখ্যা ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, দুই বছরের ব্যবধানে তা তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। সর্বোপরি দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। তবে গ্রামের তুলনায় শহরকেন্দ্রিক দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। অভাবের কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ঝরে পড়ছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। এর ফলে বাড়ছে বাল্য বিবাহ। আবার দারিদ্র্যের এ চরম অবস্থায় করা হচ্ছে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ।

এর ফলে অতি-দরিদ্র মানুষের জীবন আরো হুমকির মুখে পড়ছে। অতিদরিদ্র হওয়ার কারণ হিসেবে বিভিন্ন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছে, দেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোও জানে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমাতে তারা সুশাসন নিশ্চিত করার উপরে জোর দিয়েছেন। খবর বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও ব্যক্তি সূত্রের। উন্নয়ন গবেষক আমিনুর রসুল বাবুল বলেন, সামাজিক বৈষম্যের কারণে বাড়ছে নগরে দারিদ্র্যের হার। এটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে করোনা মহামারি।

আর নগরে একটি বড় অংশ বিভিন্ন বস্তি, ঝুপড়িঘর ও ভাসমান অবস্থান বসবাস করে। এসব হতদরিদ্র মানুষগুলো বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও অফিস আদালতে দৈনিক ও মাসিক চুক্তিতে কাজ করে তাদের সংসার পরিচালনা করে থাকেন। এর মাধ্যমে তারা অর্থনীতির চাকা রাখছেন সচল। কিন্তু বিনা-নোটিসে তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ফলে তাদের আয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ।

কিন্তু করোনা কালে তা বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। অর্থাৎ কভিডের আগে এ স্তরের মানুষের সংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, বর্তমানে তা তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণার তথ্যমতে, করোনায় কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ও আয় কমেছে। ফলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।

করোনা পরিস্থিতিতে সেই হিসাবে আমূল বদলে গেছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিটিউট অব গভর্ন্যান্স ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার কারণে দেশে নতুন করে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ গরিব হয়েছে। নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। গরিব মানুষের সংখ্যা দেশে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটির বেশি।

এ কারণে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের পাশাপাশি দারিদ্র্যের মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ। প্রাপ্ত তথ্যমতে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বজুড়ে উন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রহণ করেছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। বাংলাদেশসহ ১৯৩টি দেশ পনেরো বছর মেয়াদি ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে শুধু টেকসই বিশ্ব নয়, বরং সমৃদ্ধ, সমতা ও সুবিচারের দিক থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এসডিজি বৈশ্বিক উন্নয়নের একটি নতুন এজেন্ডা।

শ্রমিক নেতা আবুল হোসেন বলেন, দেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে। এটি রাজনৈতিক দলগুলোও জানে। সমতা আনতে হলে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু দেশে সুশাসনের অভাবে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। নগরবাসী বস্তি উন্নয়ন সংস্থার যুগ্মসচিব বলেন, সরকার একদিকে টেকসই উন্নয়নের কথা বলছে। অন্যদিকে নগরের উন্নয়নের চালিকাশক্তি দরিদ্র বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করছে। এর ফলে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন করতে হলে উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে।

বস্তিবাসীর অধিকার সুরক্ষা কমিটির নেত্রী হোসনে আরা বলেন, দরিদ্র মানুষের বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করে উন্নয়ন সম্ভব না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী এবং প্রোজেক্ট ম্যানেজার, কাপ-এর মাহবুল হক। তিনি বলেন, সম্পদের অসম বণ্টন, বৈষম্য সাম্প্রতিক কালের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য। বলেন, আমরা একদিকে যখন দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলছি, অন্যদিকে তখন সম্পদের বৈষম্য বেড়েই চলেছে।

ধনী-গরিবের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান দারিদ্র্যকে আরো আপেক্ষিকভাবে প্রকট করে তুলেছে। নগরে সম্পদের বৈষম্য যত বাড়বে ধনী ও গরিবের বিভক্তি তত প্রকট হবে। এই প্রকট এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও বিভক্তি টেকসই উন্নয়নের পথে বড় একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন এই মানবাধিকার কর্মী।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password