কৃষিসমৃদ্ধ লক্ষ্মীপুর জেলায় প্রায় ১৮ লাখ মানুষের বসবাস। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাথে এখানকার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই অনুন্নত। পণ্য পরিবহন ও চলাচলের জন্য রয়েছে একমাত্র সড়ক ব্যবস্থা। একপথে সব ধরনের চলাচল করতে গিয়ে পোহাতে হচ্ছে নানা দুর্ভোগ। বন্দরনগরীর সাথে ফেনী, নোয়াখালীর চৌমুহনী ও লক্ষ্মীপুরে রেললাইন সংস্থাপন হলে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রসার ঘটবে। পণ্য পরিবহন ব্যয় হ্রাসসহ যাতায়াত ব্যবস্থা সহজতর হবে বলে দাবি স্থানীয়দের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে একবার চৌমুহনী থেকে লক্ষ্মীপুর রেলপথ স্থাপনের জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। পরে নানা জটিলতায় ও উদ্যোগের অভাবে থমকে যায় এর কার্যক্রম। এরপর ৪৬ বছরেও লক্ষ্মীপুর জেলা রেললাইনের আওতায় আসেনি।
সম্প্রতি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘দিনাজপুর এক্সপ্রেস’ রেল উদ্বোধনকালে, ‘দেশের প্রত্যেক জেলায় রেললাইন উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’র প্রতিশ্রুতি দেন। এতে আবারও আশায় স্বপ্নবুনে লক্ষ্মীপুর জেলাবাসী। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটাতে লক্ষ্মীপুরে দ্রুত রেললাইন স্থাপনের দাবি তাদের।
বিগত ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে রেললাইন স্থাপনের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এম আলাউদ্দিন তৎকালীন সাবেক রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক এর কাছে লিখিতভাবে আবেদন জানান। আবেদনের প্রেক্ষিতে রেলমন্ত্রী নীতিমালার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রেলওয়ের চট্টগ্রাম (পূর্বাঞ্চল) মহাব্যবস্থাপককে নির্দেশ দেন। এরপর ওই বিভাগের দৃশ্যমান কোনো কাজ সম্পর্কে জানা যায়নি।
লিখিত আবেদনে উল্লেখ করা হয়, লক্ষ্মীপুর জেলায় রেলপথ, নৌপথ ও বিমান পথ বলতে কিছুই নেই। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকা থেকে পণ্য আনা নেওয়া করতে হয় সড়কপথে। এতে প্রচন্ড দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ফেনী-চৌমুহনী-লক্ষ্মীপুর রেলপথ সংযোজন করা হলে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর জেলার প্রায় ৮০ লাখ মানুষ রেল সুবিধার আওতায় আসবে।
আওয়ামী লীগ নেতার আবেদন ছাড়াও একই মাসের ৩১ তারিখে যোগাযোগমন্ত্রী (সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী) ওবায়দুল কাদের এমপি এ অঞ্চলে রেললাইন স্থাপন চেয়ে রেলমন্ত্রীর কাছে একটি চাহিদাপত্র দেন (ডিও নং-যোম/মামদ/২০১৪-৪৯১)। মন্ত্রীর দেওয়া চাহিদাপত্রে জনস্বার্থে ফেনী, চৌমুহনী ও লক্ষ্মীপুর রুটে রেলপথ ব্যবস্থা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম আলাউদ্দিন বলেন, তদ্বির ও উদ্যোগের অভাবে আজও এ জেলায় রেললাইন স্থাপন হয়নি। বর্তমান সরকার রেলওয়ে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক জরুরিভিত্তিতে লক্ষ্মীপুরে রেললাইন স্থাপন করার দাবি জানাই। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ পণ্য সামগ্রী ও যান চলাচল সহজতর হবে বলে তিনি জানান।
স্থানীয়রা জানায়, উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর নারিকেল, সুপারি, সয়াবিন ও ধান উৎপাদনে বিখ্যাত। এছাড়াও জেলাঘেঁষা মেঘনা নদীতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়। এক কথায় এজেলা কৃষি নির্ভর। এখানকার উৎপাদিত কৃষিপণ্য সরবরাহ হয়ে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে। একমাত্র সড়কপথ হওয়া সরবরাহে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। এ জন্য অনেক সময় পণ্য বিক্রি করতে কৃষকদের লোকসান গুণতে হয়। তাই এ অঞ্চলে দ্রুত রেললাইন স্থাপনের দাবি তাদের।
রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন কয়েকশ ট্রাক লক্ষ্মীপুরে পণ্য আনা নেওয়া করে। শত শত বাস হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে চলাচল করে ঢাকা-লক্ষ্মীপুর সড়কপথে। অপরদিকে ভোলা জেলার মানুষও লক্ষ্মীপুর-ভোলা ফেরি পার হয়ে একই সড়কে ঢাকায় যাতায়াত করছে। এছাড়াও খুলনা-বরিশালসহ ২১ জেলার পণ্য পরিবহন ও চলাচলের একমাত্র পথ লক্ষ্মীপুর মজু চৌধুরীরহাট-ভোলা ফেরি রুট। লক্ষ্মীপুরের মেঘনার তীরে একটি নৌবন্দর ও সাড়ে ৩ হাজার একর জায়গায় একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার। সবদিক বিবেচনায় এটি রেলের জন্য লাভজনক রুট হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল বলেন, রেল স্থাপনের বিষয়টি দুইবারই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হয়েছে। তাছাড়াও সংশ্লিষ্ট দপ্তরেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো সুফল আসেনি। তবে বিষয়টি অনেক সময়ের ব্যাপার।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারের সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য একেএম শাহজাহান কামাল এমপি বলেন, মন্ত্রীর দায়িত্ব থাকাকালে এ জেলায় রেললাইন স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথেও কয়েকবার আলোচনা হযেছে। বিষয়টি রেল মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সংসদ নির্বাচনের পর রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব বদল হওয়ায় কার্যক্রমে কিছুটা ধীরগতি হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, স্বাধীনতার পর প্রথম সরকারের অধীনে এলাকার এমপি থাকাকালেও ১৯৭৩ সালে এ জেলায় রেললাইন স্থাপনের জন্য জরিপ করা হয়। কয়েকটি স্টেশন শনাক্তসহ স্টেশন নম্বরও নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে এটি সামনে আর অগ্রসর হয়নি। বর্তমান সংসদেও বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। খুব শিগগিরই এর সুফল পাওয়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন