শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।

শুভ জন্মদিন  কিংবদন্তি স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
MostPlay

বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার সুফলকে যিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন গণ মানুষের কাতারে‌। আজীবন তাঁর সৃষ্টির সুফল ভোগ করেছে  এদেশের মানুষ। তাঁর জীবনের সবটুকু জুড়েই ছিলো এদেশের মানুষ, বলতেন, 'আমার সমস্ত কিছুর কেন্দ্রবিন্দুই এদেশের মানুষ ভালো থাকবে বলে।'.

দেশপ্রেম তাঁকে ইউরোপ থেকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলো। ১৮৯২ সালে  কলকাতায় মাত্র  ৭০০ টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে তুলেছিলেন উপমহাদেশের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। আজীবন বলতেন বাঙ্গালী তরুণদের,  "চাকরি না করে ব্যবসা করো।

একটা সমগ্র জাতি শুধুমাত্র কেরানী বা মসীজীবী’’ হয়ে টিকে থাকতে পারে না। বর্তমান খুলনা টেক্সটাইল মিলস ও তাঁর হাতে গড়া।

.উপমহাদেশে যে এতো উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছে, এই যে  ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়ন,  বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর  ভূমিকা।

এই যে আমরা সমবায় ব্যবসায়ের কথা বলি। এই সমবায় ব্যবসায়কে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ই। 

.সবার আগে ছিলো তাঁর মানবতাবোধ। ‘১৯২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় সমগ্র বাংলা ঘুরে ঘুরে  অর্থসংগ্রহ এবং ত্রাণকার্য করেছিলেন নিজে। 

.শুধু ১৯২২ নয়, তার আগের বছর চতুর্থ বার ইংল্যান্ড ভ্রমণ শেষে তিনি দেশে ফিরলেন। , খুলনা জেলার সুন্দরবন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলেন।  নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছিলেন,

‘‘দুর্গতদের সেবাকার্যের ব্যবস্থা এবং দেশবাসীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিবার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করিলাম। দেশবাসী সর্বান্তকরণে সাড়া দিল— যদিও গবর্নমেন্ট সরকারীভাবে খুলনার দুর্ভিক্ষকে স্বীকার করেন নাই।’’.

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা কলেজে বিজ্ঞান ক্লাসে ইংরেজিতে লেকচার দিতেন শিক্ষকেরা। 

এতো বিখ্যাত প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি হওয়া স্বত্বেও পিসি রায় ক্লাসে বাংলায় লেকচার দিতেন। বাংলা ভাষা ছিলো তাঁর অস্তিত্বের সাথে মিশে।

প্রতিটি ছাত্রের প্রতি ভীষণ যত্নবান। ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর মতো এতো দারুণ শিক্ষক আর খুঁজে পাওয়া যায়না। আজীবন বিজ্ঞান দিয়ে মূল্যায়ন করতেন। মাঝে মাঝে বলতেন 

.আজীবন ছিলেন প্রচন্ড অসাম্প্রদায়িক। বলতেন সবার আগে মানুষ, তারপর ধর্ম।

১৯২৫ সালে  ড. কুদরতে খুদা প্রেসিডেন্সী কলেজে থেকে রসায়নে প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন।  বহু শিক্ষক এর বিরোধিতা করেছিলো। বলেছিলো ও একজন মুসলমান হয়ে প্রথম বিভাগ পাবে এটা মেনে নেয়া যায়না। কিন্তু শত বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন, ও যোগ্য। ও অবশ্যই পাবে। ও মেধাবী, ওর মেধার  পরিচয় ওর খাতায়। ধর্মে নয়। ধর্ম কখনো মেধার নির্ণায়ক না। আজীবন আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ছিলেন মানবিক ও যুক্তি।

একবার রসায়ন ক্লাস চলছে।  এক ছাত্র হাড় দিয়ে তান্ত্রিক সাধনার কথা বলতো। তিনি শুনে  ছাত্রদের সামনে এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে মুখে পুরে দিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বললেন, এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট। এছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা কোন প্রাণীর হাড় তা-ও আর চেনার উপায় নেই। 

রসায়ন দিয়ে শুধু রসায়ন শিক্ষাই নয়, ছাত্রদের মনে ধর্মান্ধতার মূল উপড়ে ফেলেছিলেন তিনি।

প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মূল মন্ত্র ছিল তাঁর দেশসেবা। চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে লেখা তাঁর চিঠি পড়লেই বোঝা যায়। 

তিনি লিখেছিলেন‘ ‘প্রিয় ভগিনী, আমি আপনাকে নিশ্চিতরূপে বলিতে পারি যে, যখন বিজ্ঞান চর্চা করি, তখন বিজ্ঞানের মধ্য দিয়া দেশকেই সেবা করি। আমাদের লক্ষ্য একই, ... আমার জীবনের অন্য কোনও উদ্দেশ্য নাই।’’ 

 মারকিউরাস নাইট্রাইড (HgNO2) এর আবিস্কারক তিনি। যেটি সারাবিশ্বে আলোড়িত হয়েছিলো। কেবল এটিই নয় ,  ১২টি যৌগিক লবণ, এবং ৫টি থায়োএস্টারের আবিস্কারক ও তিনি।

জীবনে বিয়ে করার অবসরটুকু পাননি কখনো। অথচ এতো বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও থাকতেন কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের একটি অতি সাধারণ কক্ষে। আসবাবপত্রের মধ্যে ছিলো একটি খাটিয়া, দুটি চেয়ার, ছোট একটি খাবার টেবিল, একটি পড়ার টেবিল ও জামাকাপড় রাখার একটি সস্তা আলনা। ছিঃ ছিলো তাঁর আসবাবপত্র। 

তিনি পরতেন কম দামের মোটা খোটা ধুতি, চাদর, গেঞ্জি অথবা গায়ে একটি কোট। 

খাওয়া দাওয়াও ছিলো একবারেই সাধারণ। সকালে মাত্র এক পয়সার নাস্তা। এক পয়সার বেশি নাস্তা হলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন তিনি। অনান্য খাবারদাবারও খুব সাদামাটা।

 অথচ তখন মাসিক আয় হাজার টাকার উপরে। মোট আয় থেকে নিজের জন্য মাত্র ৪০ টাকা রেখে বাকি সব দান করে দিতেন। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার পিসি রায় দান করেছিলেন ১ লাখ ৩৬ হাজার বেশী। অথচ  তাঁর  মাসিক খরচের জন্য রাখতেন মাত্র ৪০ টাকা। 

একবার শেরে বাংলা একে  ফজলুল হক ৫-৬ দিন ক্লাসে না আসায় একদিন বিকেলে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁর বাসায় যান। ফজলুল হক তখনও খেলার মাঠে থাকায় তিনি তাঁর জন্য অপেক্ষা করেন। ফজলুল হক ফিরে এসে স্যারকে দেখে তিনি কতক্ষণে এসেছেন জানতে চাইলে বলেন ‘তোমাদের হিসেবে এক ঘন্টা আর আমার হিসেবে ষাট মিনিট’। ভীষণ সময়

বৃটিশ গোয়েন্দা দপ্তরে স্যার পি সি রায়ের নাম লেখা ছিল ‘বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী’।  স্বদেশি আন্দোলনের প্রথম পর্যায় থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যখন বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন গোপনে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য তিনি বিপ্লবীদের অর্থ সাহায্য করতেন।  

একবার ভারতের অবস্থা জানার জন্য ইংল্যান্ডে সাইমন কমিশন গঠন করা হয়। লন্ডনেই তাঁরা কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের অনেক সুনাম শুনেছেন। তাঁরা আরও জানতে পারেন বিজ্ঞান কলেজে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী  আছেন। এবং তখনই তাঁরা বিজ্ঞান কলেজ পরিদর্শনে আসতে চাইলেন। একদিন দুপুরের দিকে কমিশনের সদস্যরা বিজ্ঞান কলেজে এলে দেখেন পিসি রায় গামছা পরে ধুতিখানা রোদে শুকাচ্ছেন। ঘরে ঢুকে দেখেন এক কোণে স্টোভে  রান্না হচ্ছিল। অন্যদিকে সাদামাটা একটা খাট। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল আর একটা সাধারণ চেয়ার। পোশাক রাখার জন্য একটা কমদামি আলনা। ঘরের অবস্থা দেখে তাঁরা বলেই ফেললেন, একি মানুষ নাকি দেবতা? 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে  লিখেছিলেন, 

"সংসারে জ্ঞানী তপস্বী দুর্লভ নয়, কিন্তু মানুষের মনের মধ্যে চরিত্রে ক্রিয়া প্রভাবে তাকে ক্রিয়াবান করতে পারে এমন মনীষী সংসারে কদাচ দেখতে পাওয়া যায়।" রবীন্দ্রনাথের সাথে ছিলো তাঁর পরম বন্ধুত্ব।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ৭০তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই মঞ্চেই  প্রফুল্লচন্দ্র রায়  পড়েছিলেন 'পূরবী', 'বলাকা', 'কথা ও কাহিনী' কাব্যগ্রন্থ থেকে অসংখ্য কবিতা। সম্পূর্ণ নিজের স্মৃতি থেকে মুখস্থ বলেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মজা করে লিখেছিলেন "যেসব জন্ম সাহিত্যিক গোলমেলে ল্যাবরেটরির মধ্যে ঢুকে পড়ে জাত খুইয়ে বৈজ্ঞানিকের হাটে হারিয়ে গিয়েছেন তাঁদের ফের জাতে তুলবো।"

শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গীতকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। আর রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো বিজ্ঞানের সমাদর করতে অবহেলা করেননি কখনও। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় একাধারে ছিলেন একজন কবিও। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা রবি- প্রয়াণ।

তাঁর ছাত্ররাও ছিলেন জগদ্বিখ্যাত। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, নীলরতন ধর, পুলিন বিহারী সরকার, রসিকলাল দত্ত, মেঘনাদ সাহা, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বিজ্ঞানী কুদরত-ই খুদা, হেমেন্দ্র কুমার সেন, বিমান বিহারী দে, প্রিয়দা ভঞ্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্র লাল দে, প্রফুল্ল কুমার বসু, বীরেশ চন্দ্র গুহ, অসীমা চ্যাটার্জির মতো কিংবদন্তিরা। 

আজ প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই মহামানবের প্রতি।  যিনি বাংলাকে এগিয়ে দিয়ে গেছেন শত বছর।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password