গারো আদিবাসীদের রান্না পদ্ধতি যা খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর

গারো আদিবাসীদের রান্না পদ্ধতি যা খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর
MostPlay

খাদ্য ছাড়া কোন প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারেনা । এ পৃথিবীতে যত জীবজন্তু রয়েছে প্রত্যেকটির জন্যই খাদ্য গ্রহন অতীব জরুরী । বেঁচে থাকার জন্য তো লাগেই আরো বেশী প্রয়োজন হয় সুস্থ্য ভাবে বেঁচে থাকার জন্য । স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, কে না জানে এ কথাটি, নতুন করে এ বিষয়ে নতুনভাবে বলার অপেক্ষা রাখেনা । এ খাদ্য বা খাবার প্রস্তোতি নিয়েও স্থান কাল পাত্র এবং এলাকা ভেদে একেক রকম, একেক ধরনের রুচি বা ভিন্ন রকম হয় । মানুষ, জাতি, গোষ্ঠী ও এলাকা ভেদে যেমন খাবারের রুচিতে রয়েছে ভিন্নতা তেমনি প্রস্তোত প্রনালী এবং উপকরণ তারও রয়েছে ভিন্নতা । 

গারোদের মূল বা প্রধান খাবার হলো ভাত । তার সঙ্গে মাছ মাংস শাক সবজি ডাল সবই তারা তরকারী রান্না করে খায় । তবে শুটকি মাছ অনেকেই পছন্দ করে । ক্ষারি রান্না খুব প্রিয় বলা চলে যা এক ধরনের খাবার সোডা দিয়ে রান্না করা হয় । বাঙালী খাবারও বর্তমানে সমানতালে খায় গারোরা । খিচুড়ি, পোলাও বিরিয়ানি সবই পছন্দ কওে তবে শুকরের মাংস, কচ্ছপ ও কুঁচে মাছ খুবই প্রিয় । বাঁশের কচি চারা ও ব্যাঙের ছাতা যাকে মাশরুম বলে এই খাবারও গারোরা খুব পছন্দ করে ।  অতিথি আপ্যায়নে বা কোন অনুষ্ঠানাদিতে ভাত দিয়ে নিজের তৈরী করা লোকাল মদ বা চু গারোদের নিকট অপরিহার্য । ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মধ্যে এটি প্রচলিত সর্বক্ষেত্রেই । 

এখন আমি যে খাবারের কথা বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো গারো আদিবাসীদের ট্রেডিশনাল খাবার বিশেষ করে তরকারী রান্না নিয়ে । এটি খুবই স্বাস্থ্যসম্মত এবং স্বাদও খুব মজার একটু অন্যরকম তো বটেই । কেন স্বাস্থ্যসম্মত বলা হয়, কারণ গারো আদিবাসীদের রান্না গুলোতে তেল, মসলা, পিয়াজ, রসুন এগুলো খুব কম ব্যবহার করা হয় বা বেশীর ভাগ রন্ধন প্রণালীতেই এ উপকরণগুলো ব্যবহার করা হয়না । বেশী পরিমাণে তেল চর্বি নিয়ে বর্তমান যুগে বেশীর ভাগ মানুষেরই কোন না কোন ভাবে কিছু সমস্যা রয়েছে, যদিও এর প্রয়োজন রয়েছে পরিমিত আকারে, শরীরের সুস্থ্যতার জন্য যেন যত কম তেল মসলা খাওয়া যায় তত ভাল এবং এটি সর্বজন স্বীকৃত, বিজ্ঞানসম্মত ।

সারা বিশ্বে  সবাই একই ধরনের খাবার খায়না যেমন তদ্রপ বাংলাদেশে বা বাংলাদেশের বাইরে যে গারো আদিবাসীরা রয়েছে তাদের খাবার প্রস্তোত প্রণালী এবং খাবার উপকরণ নিয়েই আমি সবাইকে জানাতে চাই কিছু লেখার মধ্য দিয়ে যা খুবই স্বাস্থ্য সম্মত এবং খুব রুচিসম্মত । আমার এ লেখা বা রন্ধন প্রনালী দেখে দেখে এবং পড়েই যে কেউ অতি সহজে তা রান্না করতে পারবে এবং গ্রহন করতে পারবে এ জন্যই আমার এ সীমিতভাবে ছোট প্রয়াস । সকল মানুষের সুস্বাস্থ্য কামনা করেই এ লেখাটি লিপিবদ্ধ করছি । 

আমি এখানে মূলত ভিন্ন রকমের উপকরণ অথচ আমাদের দেশে যে কোন জায়গায় অতি সহজে পাওয়া যায় এমন উপকরণ গুলো দিয়ে কিভাবে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বা তরকারী রান্না করে নিজেদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায় এবং অত্যন্ত সুস্বাদু খাদ্য গ্রহন করে তৃপ্তি পাওয়া যায় সেটা নিয়েই লিখছি । আমি নিজেও এ সমস্ত খাবার খুব পছন্দ করি এবং নিজে রান্না করে নিজের ও পরিবারের জন্য পরিবেশন করি, যদিও হাতে তেমন সময় হয়না আমার রান্না বান্না করার, তারপরও যখনই সময় পাই, ইচ্ছে হয়, তখনই এসব খাবারগুলো রান্না করতে দি¦ধা করিনা । 

অনেক ধরনের খাবার রান্না করা যায় বা রান্না করে খায় প্রতিটি এলাকার মানুষ । গারোদের মধ্যেও এলাকা ভেদে রান্নার ধরন আবার ভিন্ন রকম হয়ে থাকে । ক্ষারি জাবা-তরকারি রান্নার কথায় বলি, কেউ ক্ষারি জাবাতে-তরকারীতে আদা একটি উপকরন হিসাবে ব্যবহার করে আবার অনেকেই করেনা । উপকরণ ভেদে তরকারির স্বাদও ভিন্নরকম হয়ে থাকে । এসব খাবার যেহেতু অন্যরকম সেহেতু এটার স্বাদ টেস্ট ভিন্ন রকম হবেই । সবাই যাতে গারোদের স্পেসিয়াল ও ট্রেডিশনাল খাবার সম্পর্কে জানতে পারে, শিখতে পারে এবং রান্ন্ াকরে খেয়ে টেস্ট নিয়ে পরিতৃপ্ত হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্য গ্রহন করতে পারে তার জন্যই এ গারোদের ট্রেডিশনাল খাদ্য নিয়ে সবার জন্য লিখছি । গারোরা সব ধরনের খাবারই খায় । কোন বিধিনিষেধ নেই খাবার নিয়ে তবে মূলত বনে জঙ্গলে প্রাকৃতিকভাবে যে গাছগাছালীগুলো পাওয়া যায় সেগুলোই গারোরা খেতে বেশী পছন্দ করে ।  

মনে রাখতে হবে লবন, মরিচ এবং বেকিং সোডা(ক্ষার-খাবারের সোডা) পরিমান মত ব্যবহার করতে হবে সাধারণত অন্য তরকারী গুলোর মতই, তাহলেই অধিক সুস্বাদু হবে, কম বা বেশী হলে সুস্বাদু হয়না ।

আমি মূলত এখানে নীচের কয়েকটি উপকরণ দিয়ে কিভাবে হলুদ, তেল, মসলা ছাড়া বা অল্প পরিমাণে খুবই সামান্ন তেল মসলা ব্যবহার করে মানসম্মত, সুস্বাদু, স্বাস্থ্য সম্মত গারো ট্রেডিশনাল মূখরোচক তরকারী রান্না করা যায় তার রেসিপি বর্ননা করছি । এখানে আমি নীচের প্রতিটি কি উপকরণ দিয়ে কিভাবে বিভিন্ন ধরনের রান্না করা যায় তার পদ্ধতি মূলত বর্ননা করছি ঃ

১। মুরগী মাংস দিয়ে ভিন্ন ধরনের রান্না

২। তিত বেগুন (খিমখা) দিয়ে রেসিপি 

৩। মেন্দা পাতা বা চুকোর/চুকাই পাতা দিয়ে ভিন্ন রেসিপি  

৪। মিআ (ছোট কচি বাঁশ কোরল) দিয়ে রেসিপি

তাহলে শুরু করা যাক গারোদের ট্রেডিশনাল রান্না পদ্ধতিঃ

১। দঅ (মুরগী) ক্ষারি জগেকা জাবা (তরকারী)

   

উপকরণ সমূহঃ

- এক কেজি মুরগী(১টা)

- লবন পরিমান মত

- খাবার সোডা পরিমান মত(হাফ চা চামচের মত)

- মরিচ(কাঁচা বা শুকনা) যে কোনটিই হতে পারে পরিমান মত(১০/১২টি)

- বাটা বা কুচি করা আদা আধা কাপ

- এক কাপ এর মত পানি

সময়ঃ লাগবে ৩০ মিনিট থেকে ৪০ মিনিট(চুলাই) পরিমান অনুযায়ী সময় লাগবে । 

প্রস্তোত প্রণালীঃ

প্রথমে মুরগী কেটে ভাল করে ধোয়ে নিন এবং একটি পাত্রে রাখতে হবে । মরিচগুলো ধোয়ে কেটে নিন এবং ছোট বাতিতে রাখতে পারেন । আদা পরিমানমত নিয়ে ছুলে বেটে নিতে হবে অথবা কুচি কুচি করে কেটে নিলেও হয় তবে বেটে নিলে বা বেøন্ডার করে নিলে ভাল হয় । 

এবার উপরে উল্লেখিত খাবার সোডা/ক্ষার ও পানি ছাড়া সবগুলো উপকরণ মিশিয়ে রান্না পাত্রে দিয়ে ঢাকনা দিয়ে চুলাই বসিয়ে দেন । হালকা তাপ দিলে আরো বেশী সুস্বাদু হয় । ১০/১২ মিনিট রেখে দিবেন খেয়াল রাখতে হবে যেন মাংসের যে পানি, তা যেন শুকিয়ে পোড়ে না যায় এরপর মাংস র্অধসেদ্ধ হলে খাবারের সোডা/ক্ষার দিয়ে নাড়াতে হবে । 

পানি শুকিয়ে গেলে পরিমান মত এক কাপের মত পানি ঢেলে আবার জাল দিতে হবে । বলক উঠার পর মাংস ঝরঝরা হয়ে গেলে তা নামিয়ে পরিবেশন করেন - হয়ে গেল দও ক্ষারি জাবা । এ তরকারীতে কোন পেয়াজ রসুন হলুদ তেল মসলা ব্যবহার করা হয়না শুধু আদা ব্যবহার করা হয় বলে এ তরকারীটি বহুগুণে স্বাস্থ্যকর ।

২।  তিত বেগুন গারো ভাষাতে খিমখা বলে । খিমখা (তিত বেগুন) ও চেপা ভর্তা

   

উপকরণ সমূহঃ

- পরিমান মত তিত বেগুন 

- লবন পরিমান মত

- চেপা শুটকি ৮/১০ টা

- মরিচ(কাঁচা বা শুকনা) যে কোনটিই হতে পারে পরিমান মত(১০/১২টি)

- অর্ধেক চামচ খাবার সোডা

সময়ঃ ২০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট পরিমান অনুযায়ী সময় লাগবে । 

প্রস্তোত প্রণালীঃ

প্রথমে তিত বেগুন সুন্দর করে ছাড়াতে হবে ডাল হবে তারপর ধুয়ে নিয়ে তিত বেগুনগুলো ছেচতে হবে । সিলপাটা দিয়ে হালকা করে বা কাঠের যে বেøন্ডার পাওয়া যায় সেখানে পিষেও ছেচা যায় । মনে রাখতে হবে যেন বেশী মিহি যাতে না হয় । সামান্য করে পিষলেই হবে । রসসহ সংগ্রহ করতে হবে । আর যদি বেশী তিতা পছন্দ না করেন তাহলে ছেচে একবার ধুয়ে বীচিগুলো ফেলে দিতে পারেন ।

তারপর হাড়িতে তিত ছেচা তিতবেগুন, চেপা শুটকি, লবন, খাপবা সোডা, মরিচ একসাথে মাখিয়ে ঢাকনা দিয়ে চাপিয়ে দিবেন । সিদ্ধ হয়ে গেলে এবং পানি শুকিয়ে গেলে নামিয়ে । এরপর সবগুলো মাখালেই হয়ে গেল তিতবেগুন ভর্তা ।  

এ রান্নার মধ্যেও কোন তেল মসলা হলুদ ব্যবহার করা হয়না শুধুমাত্র পেয়াজ, মরিচ ও লবন ব্যববহার করা হয় বলে তা খুবই স্বাস্থ্য সম্মত খাবার ।

৩।  মেন্দা বিজাক (চুকোর/চুকুরি/চুক্কা পাতা) দিয়ে বিভিন্ন ধরনের রান্না হয়, মেন্দা বিজাক/চুকোর পাতা ও চেপা ভর্তা 



   উপকরণ সমূহঃ

- চুকোর পাতা 

- চেপা শুটকি ছোট হলে ১০/১২টা, একটু বড় হলে ৬/৭টা 

- লবন পরিমান মত

- পিয়াজ ৬/৭ টা 

- মরিচ(কাঁচা বা শুকনা) যে কোনটিই হতে পারে পরিমান মত(১০/১২টি)

সময়ঃ ১০ মিনিট থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগবে । 

প্রস্তোত প্রণালীঃ

চুকোর পাতা ১০/১২ টা ভালভাবে ধুয়ে নিন । চেপা শুটকিগুলোও ধুয়ে নিতে হবে । পিয়াজ দুই টুকরা বা চার টুকরা করলেও চলবে ।

এটি যেহেতু র্ভতা তাই এমনি পাতিলে সব দিয়ে মানে চুকোর পাতা, লবন, মরিচ, পিয়াজ ও চেপা শুটকি সব একসাথে দিয়ে অল্প পরিমান পানি দিয়ে ঢাকনা দিয়ে পানি শুকিয়ে সিদ্ধ করে পরি নামিয়ে হাত দিয়ে মাখিয়ে র্ভতা করলেও হয়ে যায় । 

তাছাড়াও এই সবগুলো উপকরণ ভাত প্রায় হয়ে গেলে ভাতে উপওে প্রথনে চুকোর পাতা, তার উপবে পিয়াজ, মরিচ, লবন ও চেপা শুটকি রেখে কতক্ষণ ঢেকে রাখলেও ভাবে সেদ্ধ হয়ে যায় । পরে সেগুলো নামিয়ে বাটিতে আলাদা করে মাখিয়ে নিয়েও ভর্তা করা যায় এইভাবে বানানো ভর্তা আরো বেশী স্বাদেও হয় ।

৪. মিআ (কচি বাঁশকোরল) দিয়ে তেল হলুদ মসলা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রান্না করা যায় । মিআ (কচি বাঁশ-কোড়ল) ও হাঁস মাংস জাবা



 উপকরণ সমূহঃ

- এককেজি হাঁস এর মাংস (১টা)

- আধা কেজি বা মাঝারি কোড়ল(কচি বাঁশ)

- লবন পরিমান মত

- মরিচ(কাঁচা বা শুকনা) যে কোনটিই হতে পারে পরিমান মত(১০/১২টি)

- অর্ধেক চামচ খাবার সোডা

- দুই চামচ আদা কুচি করা 

- হাফ লিটার এর মত পানি

সময়ঃ ৪০ মিনিট থেকে ৫০ মিনিট পরিমান অনুযায়ী সময় লাগবে । 

প্রস্তোত প্রণালীঃ

হাঁসের মাংস একটু ছোট করে টুকরা করতে হবে  এরপর ভালভাবে ধুয়ে নিয়ে যে পাত্রে রান্না করবেন সেখানে সরাসরি রাখতে পারেন । এরপর আগে থেকে প্রস্তোত করা কোড়ল, আদা, লবন, মরিচ, সোডা সব মিশিয়ে ঢাকনা দিয়ে চুলাই বসিয়ে দিবেন । 

মাঝে মাঝে নাড়াতে হবে যেন ভালভাবে সব উপকরণ মিশে যায় । এভাবে সিদ্ধ হয়ে গেলেই রান্না হয়ে গেল । ঝুল না রাখলেই ভাল । পানি একটু বেশী দিতে হয় কারণ হাঁসের মাংস এবং কোড়ল দুঠিই যেন ভালভাবে সিদ্ধ হয় ।

প্রয়োজনে টেস্টি বাড়ানোর জন্য নামানোর আগে এক চামচের মত আদা দিয়ে দিতে পারেন । তখন ফ্লেবারটা আরো বেশী সুন্দর হয় । এই রান্না করা খাবার খুবই মজাদার একটি খাবার । বার বার খেতেই ইচ্ছে করবে শুধু । 

এ রান্নাার মধ্যেও কোন তেল মসলা হলুদ ব্যবহার করা হয়না শুধুমাত্র কোড়ল, আদা, সোডা, মরিচ ও লবন ব্যববহার করা হয় বলে তা খুবই স্বাস্থ্য সম্মত খাবার ।

#গারোদের ট্রেডিশনাল খাবার,  #গারো রান্না পদ্ধতি, #ব্লগ, #ক্রিয়েটিভ , #মশলা ছাড়া রান্না 

#স্বাস্থ্যকর, #সুস্বাদু, #মজাদার, 

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password