জহুরুল (২১) আর আমিরুল (১৭) দুই ভাই। তারাই দিনমজুর বাবার ভবিষ্যৎ জীবনের আশার আলো। কিন্তু সেই আলো আজ নিভতে বসেছে। কেননা হতদরিদ্র পরিবারের ২ ভাই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত।
প্রতি মাসেই তাদের শরীরে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। মায়ের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিল না থাকলেও বাবার সঙ্গে মিল আছে। রক্ত যখন আর সংগ্রহ করতে না পারেন তখন নিজেই রক্ত দেন বাবা। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা নিজের শরীর থেকে এ পর্যন্ত ৩৬ ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন।
নিয়ম না মেনে দফায় দফায় রক্ত দেওয়ায় তার শরীরও হয়ে পড়েছে দুর্বল। এভাবে ২০টি বছর কাটছে এই পরিবারের। জহুরুল ও আমিরুল ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের শাহপুর গ্রামের লাল মিয়ার ছেলে। জহুরুল ও আমিরুল ছাড়াও ঝুমুর নামে তাদের এক মেয়ে আছে। মেয়েটি এখনও সুস্থ আছে। সে শাহাপুর ঘিঘাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণিতে পড়ে।
সরেজমিন তাদের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, একটি কক্ষের মেঝেতে অসুস্থ ২ ভাই শুয়ে কাতরাচ্ছে। আর তাদের মা মোমেনা বেগম ঘরের সামনে বসে কাঁথা সেলাই করছেন আর চোখের পানি ফেলছেন। বাবা লাল মিয়া অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ির সামনের রাইস মিলে কাজ করছেন।
মা মোমেনা বেগম বলেন, বসতভিটার ৬ শতক জমিই আমাদের একমাত্র সম্বল। স্বামী লাল মিয়া সারাজীবন পরের ক্ষেতে কামলার কাজ করেন। তখন সংসারে অভাব থাকলেও মনে শান্তি ছিল। পরিশ্রম করে ইটের ঘরও দিয়েছিলাম।
কিন্তু শিশু অবস্থায় ৩-৪ বছর বয়স হলেই ২ ছেলেরই প্রায়ই জ্বর হতো। সে সময়ে তাদের শরীরে রক্তের স্বল্পতাও দেখা দেয়। শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অলোক কুমার সাহা অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষায় নিশ্চিত হন ২ ছেলেই দূরারোগ্য থ্যালোসেমিয়ায় আক্রান্ত। তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরি। এ পর্যন্ত দুই ছেলের পেছনে সব শেষ হয়ে গেছে।
বাবা লাল মিয়া বলেন, আমার রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ। দুই ছেলেরও একই গ্রুপ। এ পর্যন্ত মানুষের দেয়া অর্থ ও রক্তের সাহায্যে আল্লাহর রহমতে ছেলে দুটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। তারপরও অনেক সময়ে রক্তদাতা পাওয়া যায় না। এদিকে ছেলেদের অসুস্থতার কাঁতরানিতে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সহ্য করতে পারি না।
তখন আর পৃথিবীর কোনো কিছুই ভালো লাগে না। নিজের দিকে খেয়াল না করে অসুস্থ শরীরে রক্ত দিয়ে থাকি। এ পর্যন্ত নিজের শরীর থেকে মোট ৩৬ ব্যাগ রক্ত তাদের দিয়েছি। এখন আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
তিনি বলেন, মাঠে কোনো জায়গা জমি নেই। সারা বছর অভাবের মধ্যে থেকে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে। এদিকে পরিবারের সদস্যদের খাবারের জোগান দিতে নিজের অসুস্থ শরীরে রাইস মিলে কঠোর পরিশ্রম করি। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, সব মানুষেরই ভবিষ্যতে ভালো কিছুর আশা থাকে। আমারও সন্তানদের নিয়ে আশা ছিল কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকারে ঢাকা।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. আব্দুস ছাত্তার জানান, থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ; যা নিরাময়যোগ্য নয়। রোগীর শরীরে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তবে মাইনর অবস্থায় থাকলে শুধু রক্ত দিলেই হয়; কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে লিভারের অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে। তখন ব্যয়বহুল অপারেশন করতে হয়।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন