নওগাঁয় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি

নওগাঁয় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি
MostPlay

নওগাঁয় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি গত এপ্রিল ও চলতি মাসে ঝড়-বৃষ্টিতে দেশের অন্যতম প্রধান ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁয় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। এর সঙ্গে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে ব্লাস্ট রোগ।

ঝড়ে ধান গাছ নুইয়ে পড়া, খেতে বৃষ্টির পানি জমে ধান নষ্ট হওয়া এবং ব্লাস্ট রোগের কারণে চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ শতাংশ ধান উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে বড় অংশই জিরা, কাটারিভোগ, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের ধান। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যামাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ লাখ মেট্রিক টন। গত রোববার পর্যন্ত ২০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে।

স্থানীয় কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, গত এপ্রিল ও চলতি মাসে হওয়া ঝড়-বৃষ্টিতে বোরো ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির। এপ্রিল মাসে মাঝামাঝি সময়ে হওয়া ঝড়-বৃষ্টির পরপরই জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মাঠে ধান খেতে ‘ব্লাস্ট’ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে জিরা ও বিআর-২৮ জাতের ধান খেতে। ধানের ছত্রাকজনিত এ রোগ যেসব খেতে ছড়িয়েছে ওই সব খেতের ধান সম্পূর্ণ শুকিয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে ধানগাছের পাতাও। অনেক কৃষক সময় মতো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় খেতের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত ব্লাস্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ধান সব চিটা হয়ে যাচ্ছে নিমেষে। কৃষকদের দেওয়া তথ্য মতে ঝড়-বৃষ্টি ও ব্লাস্ট রোগের কারণে এবার গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ ধান কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝড়ে ধানগাছ নুইয়ে পড়া এবং নুইয়ে পড়া ধান খেতে পানি জমে যাওয়ায় ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

শ্রমিক সংকটের কারণে সময়মতো খেতের ধান ঘরে তুলতে না পারায় নুইয়ে পড়া ধান পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্লাস্ট রোগে ধান চিটা হয়ে যাওয়ায় ধানের উৎপাদন কম হচ্ছে। গত বছর যেসব জমিতে প্রতি বিঘায় ধানের ফলন হয়েছে ২৮ থেকে ৩০ মণ ওই সব জমিতে এবার ১৮ থেকে ২০ মণ। এই হিসেবে গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ৩০ শতাংশ ধানের উৎপাদন কম হতে পারে। অন্যদিকে কৃষি বিভাগ বলছে, ঝড়-বৃষ্টি ও ব্লাস্টের কারণে বোরো ধানের যে ক্ষতি হয়েছে তাতে এবার উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হতে পারে। এবার ধান উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাতা নির্ধারণ করা হয়েছে তার চেয়ে ২০ শতাংশ ধান উৎপাদন কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ।

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) শামীম ইকবাল বলেন, ‘বোরো ধান কাটার ভরা মৌসুমে এবার ঘন ঘন ঝড়-বৃষ্টিতে এ অঞ্চলে বোরোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে ঝড়-বৃষ্টির আবহাওয়া ব্লাস্ট রোগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এবার বৈশাখ জুড়েই এ রকম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছে। সে কারণে নওগাঁর কিছু কিছু অঞ্চলে ধান খেতে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি ও ব্লাস্টের কারণে এবার প্রায় ২০ শতাংশ ধান উৎপাদন কম হতে পারে। বিভিন্ন এলাকায় শস্য কর্তন করে দেখা যাচ্ছে, গত বছর যেই সব জমিতে ২৫ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে, এবার সেখানে ২০ মণ উৎপাদন হচ্ছে।’ গত রোববার ও গতকাল সোমবার নওগাঁ সদর উপজেলার বর্ষাইল, রাণীনগর উপজেলার বিশা, কালিগ্রাম, আত্রাই মনিয়ারী ও নিয়ামতপুর উপজেলার চন্দনগরসহ বিভিন্ন এলাকার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, এখন হাজার হাজার একর জমির পাকা ধান মাঠে পড়ে আছে। অনেক খেতে পানি জমে রয়েছে। পানি জমে থাকায় ধান থেকে আবারও নতুন করে ধানগাছ জন্ম নিচ্ছে। ব্লাস্ট রোগের কারণে মাঠের কোনো কোনো খেতের ধানের শীষ একেবারেই মরে গেছে। ধান চিটা হয়ে গেছে। গাছের ওপরের দিকটা মরে খড়ের মতো হয়ে গেছে।

রাণীনগর উপজেলার ভোপাড়া গ্রামের জাহির উদ্দিনের নৌদিঘী মাঠে আবাদ করা আড়াই বিঘা জমির ধান পুরোটাই চিটা হয়ে গেছে। একই এলাকার কৃষক আনসার আলী জানান, এবার তিনি ১০ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছেন। ঝড়ে তাঁর খেতের সব ধান নুইয়ে পড়েছে। খেতে জমে থাকা পানিতে ধানগাছ নষ্ট হতে বসলেও শ্রমিকের অভাবে সেই ধান কাটতে পারছেন না। তার ওপর শেষ সময়ে এসে দেখা যায়, ধানের শিষ মরে সাদা হয়ে যাচ্ছে। ধান কাটা শ্রমিকের তীব্র সংকট: ঈদুল ফিতরের আগেই মাঠের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ধান পেকে গেলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ২০ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। ধান পেকে গেলেও শ্রমিকের অভাবে মাঠের ধান ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষকেরা। এদিকে কিছু দিন ধরে চলছে বৈরি আবহাওয়া। প্রায় প্রতিদিনই ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।

স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, মাঠের ধান পেকে গেছে। কিন্তু শ্রমিকের অভাবে তাঁরা ধান কাটতে পারছেন না। বিশেষ করে নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়ার বিল, মান্দার ঠাকুরমান্দা, ভারশোঁ, আন্দাসুরা, নওগাঁ সদরের বিল মনসুর, হাঁসাইগাড়ী, সরইল, দিঘলীর বিলসহ বিভিন্ন নিম্নঞ্চল যেসব কৃষক ধান আবাদ করেছেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। কারণ সামন্য বৃষ্টিতেই বিলের ধান ডুবে যায়। ঈদের দিন থেকে প্রায় প্রতি দিনই থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। অনেক জমিতে পানি জমি গেছে। আরেকটু বৃষ্টি হলেই অনেক মাঠের ধান পানিতে তলিয়ে যাবে। এ অবস্থায় আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখলেই শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন তাঁরা। বিভিন্ন এলাকার কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধানের দাম বেশি থাকলেও এ বছর বোরো ধানে খুব বেশি লাভ হবে না কৃষকের। সেচ খরচ, সার ও পরিচর্চা বাবাদ প্রতি বিঘা জমিতে ৮ থেকে ৯ হাজার করে টাকা খরচ হয়েছে। তারপর ঝড়-বৃষ্টি ও ব্লাস্টের কারণে খেতে প্রায় ৩০ শতাংশ ধানের ফলন কম হবে। শ্রমিক সংকটের সুযোগ নিয়ে গত বছর এক জমির ধান কাটতে যে পরিশ্রমিক নিতে এবার তার দ্বিগুন পারিশ্রমিক দাবি করছেন। প্রতি জমির ধান কাটতে খরচ পড়ছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা।

জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ জানান- ‘বর্তমানে মাঠের প্রায় শতভাগ ধান পেকে গেছে। আমরা কৃষকদের দ্রুত মাঠের ধান কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষকেরা ধান কাটতে পারছেন না। বাইরে থেকে এবার কম শ্রমিক আসায় শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আশা করা যাচ্ছে, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে বাইরে থেকে পর্যাপ্ত শ্রমিক চলে আসবে। আগামী এক-দুই সপ্তাহের আবহওয়া অনুকূল থাকলে আর কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মাঠের ধান কাটা হয়ে যাবে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password