বাঁধের কাজে আগ্রহ হারাচ্ছেন হাওরপাড়ের মানুষ

বাঁধের কাজে আগ্রহ হারাচ্ছেন হাওরপাড়ের মানুষ
MostPlay

হাওরের ফসলরক্ষায় পিআইসি প্রথাকে ব্যর্থ করতে নানা অপপ্রচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বিরুদ্ধে। ফলে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ নিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন হাওরপাড়ের কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা।

সরেজমিনে উপজেলার বৃহৎ হাওর নলুয়ার হাওর ঘুরে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সংস্কার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব কথা। তাদের ভাষ্যমতে, উপজেলাবাসী একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। ঠিকাদারী প্রথায় যখন হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সংস্কার কাজ হতো, তখন নামমাত্র কাজ করে ৩০ জুনের মধ্যে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সংস্কার কাজের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে লুটপাট করা হতো।

যার ফলশ্রুতিতে ২০১০ সালে জগন্নাথপুরের হাওরগুলোতে ফসল পাকার আগেই নিম্নমানের বাঁধগুলো ভেঙে ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। এ ছাড়া ২০১৭ সালে জগন্নাথপুরসহ সুনামগঞ্জ জেলার সবকটি হাওরে ফসলডুবির ঘটনা ঘটে। কৃষকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঠিকাদারী প্রথা বাতিল করে হাওরের ফসলরক্ষায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) প্রথা চালু করা হয়। শুরু থেকেই পিআইসি প্রথাকে বিতর্কে ফেলতে নানা ফন্দি আঁটে পাউবো। এখন পিআইসি নিতে কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের আগ্রহ নেই।

কথা হয় জগন্নাথপুর পৌর শহরের জগন্নাথপুর গ্রামের কৃষক নুরুল হকের সঙ্গে। গত বছর হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ সংস্কার নলুয়া হাওরের পোল্ডার-১ এর আওতাধীন ২৪ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি ছিলেন তিনি। পাউবোর নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করেছেন তিনি এবং নির্বিঘ্নে ফসল ঘরে তুলেছেন কৃষকরা। কিন্তু তিনি এখনও পাননি চূড়ান্ত বিল। গত বছরের ধার-দেনার চাপে তিনি পাওনা টাকার জন্য ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। শুধু নুরুল হক নন, উপজেলার আরও কয়েকটি প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষক ও জনপ্রতিনিধি গত বছরের পাওনা টাকা না পেয়ে দিশেহারা।

২৪নম্বর প্রকল্পের সভাপতি কৃষক নুরুল হক বলেন, পিআইসি প্রথায় ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ ভালো হলেও পাউবো পিআইসি প্রথাকে ব্যর্থ করতে ঠিকাদারি প্রথাকে পছন্দ করে। যে কারণে পিআইসিদের নানা হয়রানি করা হয়। আমার প্রকল্পে নীতিমালা অনুযায়ী কাজ হলেও ৮ লাখ টাকা বরাদ্দের মধ্যে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা বিল পেয়েছি। বাকি টাকা না পাওয়ায় খুব কষ্টে আছি।

নলুয়া হাওরের ১০নম্বর প্রকল্পের দায়িত্বরত চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সুজাত মিয়া বলেন, এই প্রকল্পটি স্থানীয় এক কৃষককে দেওয়া হয়েছিল। ওই কৃষক প্রকল্পটি নেননি। কেউ নিতে আগ্রহী হয়নি। তাই একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে জোরপূর্বক দেওয়া হয়েছে প্রকল্পটি।

চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরশ মিয়া জানান, ঠিকাদারি প্রথায় যখন ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ হতো তখন ৩০ জুনের মধ্যে কাজ না করেই ঠিকাদার আর পাউবো ভাগ-বাটোয়ারা করে চূড়ান্ত বিল তুলে নিয়ে যেত। পিআইসিরা কাজ করে টাকা পায় না। ফলে এখন পিআইসি নিতে কৃষক ও জনপ্রতিনিধির কোনো আগ্রহ নেই।

নলুয়া হাওরের ৬ নম্বর প্রকল্পের ভুরাখালী পয়েন্ট এলাকায় বিশাল একটি ভাঙা রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, মাছ ধরার জন্য একটি মহল হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধে ভেঙেছে। ওই বড় গর্ত ভরাটের কাজ করছেন শ্রমিকরা। কাজের দায়িত্বে থাকা প্রকল্প কমিটির সভাপতি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য রনধীর কান্ত দাস নান্টু বলেন, মাটির তীব্র সংকট রয়েছে। গাড়ি দিয়ে অনেক দূর থেকে মাটি আনতে হচ্ছে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে। এই প্রকল্পে বরাদ্দ কম দেওয়া হয়েছে। তিনি জানালেন, এই প্রকল্পে ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা কাজের তুলনায় কম হয়েছে। এখন কাজ শেষে আমার লোকসান হবে।

হাওর বাঁচাও আন্দোলন জগন্নাথপুর উপজেলা কমিটির সভাপতি সিরাজুল হক বলেন, পিআইসি প্রথায় ঠিকাদারি প্রথার চেয়ে ভালো কাজ হয় এটা নিঃসন্দেহে। তারপরও পিআইসিরা হয়রানির শিকার হওয়া দুঃখজনক। হাওরের ফসলরক্ষায় আমরা আর লুটপাটের ঠিকাদারি প্রথায় ফিরে যেতে চাই না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জগন্নাপুরে এবার ৩৭টি পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠনের মাধ্যমে ৭৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। কাজের বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে বাঁধের কাজ শুরু হয়। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজের শেষ করার কথা।

এদিকে প্রথমদিকেই প্রকল্প কমিটি গঠন নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় সংশ্লিষ্টদের। এর প্রধান কারণ বাঁধের কাজে আগ্রহ নেই কারও। হয়রানি আর লোকসানের ভয়ে প্রকল্প নিতে চান না কেউ। গত ডিসেম্বরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি কাজ শুরু করার কথা থাকলেও প্রায় দুইমাস পরও কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়নি এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাওর ঘুরে দেখা গেছে. নলুয়ার হাওরের কয়েকটি প্রকল্পের বিভিন্ন স্থানে এখনও মাটি পড়েনি। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জগন্নাথপুর উপজেলার মাঠ কর্মকর্তা উপ-সহকারী প্রকৌশলী হাসান গাজী জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড পিআইসি প্রথায় কাজ বাস্তবায়নের নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করছে। কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ সঠিক না।

জগন্নাথপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহেদী হাসান বলেন, পিআইসির মাধ্যমে ভালোভাবে কাজ হচ্ছে হাওরে। সময়মতো টাকা পেলে কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password