মান্দায় ঐতিহাসিক কুশুম্বা মসজিদ মুখরিত হয়ে উঠেছে মানুষের পদচারণায়

মান্দায় ঐতিহাসিক কুশুম্বা মসজিদ মুখরিত হয়ে উঠেছে মানুষের পদচারণায়
MostPlay

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পুরাকৃর্তি  কুশুম্বা শাহী মসজিদ একটি আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট হিসেবে দেশ বিদেশিদের আগমনে ও পদচারণায় মুগ্ধ হচ্ছে । এ মসজিদটি একটি আকর্ষনীয় স্থাপনা হিসেবে দেশ বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে আসছে দীর্ঘদিন যাবত এবং করোনার মধ্যেও এবারের ঈদে মানুষে উপচে পড়া ভিড় জমেছে। মোঘল শাসন আমলে নির্মিত হয় এ মসজিদটি। 

মুসলিম স্থাপত্যের যেন এক অপূর্ব নিদর্শন এ মসজিদ । বাংলাদেশের পাঁচ টাকার কাগজের নোটে এ মসজিদের ছবি মুদ্রিত আছে। যা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জিয়ার নির্দেশে পাঁচ টাকার কাগজের নোটে মুদ্রিত করা হয়েছিল। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষসহ বিদেশি পর্যটকরা মসজিদটি এক নজর দেখতে ছুটে আসেন।

বছরের দুই ঈদে প্রচুর দর্শনার্থীদের  কলকাকলি ও ভীড়ে মুখরিত হয়ে  ওঠে এ মসজিদ প্রাঙ্গণ। মসজিদকে কেন্দ্র করে ১৫/১৬  বছর ধরে এখানে গড়ে উঠেছে খাবার দোকান সহ নানা খেলনার দোকানপাট। বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনার কারণে গত এক বছরে এখানে দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেকাংশে কমে গেছে।

নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার ও রাজশাহী সিটি থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে মান্দা উপজেলার নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের পশ্চিম পাশে কুশুম্বা গ্রামে এ মসজিদটি অবস্থিত। এটি স্থানীয়দের কাছে কালাপাহাড় নামেও পরিচিত।

আজ থেকে ৩০/৩৫ বছর আগেও দাদা, দাদী, ও মায়েদের মুখে গল্প শোনা যেত, জীনেরা নাকি এক রাতেই এটি নির্মাণ করেছেন। পাথরের লাঠির সাহায্যে জীনেরা মসজিদের সব পাথর ও মালামাল বহন বা তাড়িয়ে  নিয়ে এসেছেন। আর এ লাঠি মসজিদ থেকে একটু দক্ষিণ পূর্ব দিকে এক জমিতে দাঁড়িয়ে আছে মানুষেরা এক সময় এগুলো বিশ্বাসও করত। তবে এ-র কোন ভিত্তি নেই। সব কল্প-কাহিনী মাত্র।  

মসজিদের প্রবেশমুখে বসানো রয়েছে একটি ফলক। সেই ফলকের লিপিবদ্ধ তথ্য অনুযায়ী এ মসজিদের নির্মাণকাল ৯৬৬ হিজরি মোতাবেক ১৫৫৮-১৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দ। সুলতান গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহ্ এর রাজত্বকালে জনৈক সুলতান সোলায়মান নামের একজন শাসক  বঢক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন।

১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের তিনটি গম্বুজ কিছুটা ক্ষতি গ্রস্থ  হয়েছিল। 
সে সময় জানা যায়, মসজিদটি আসলে ইটের তৈরি। তবে দেয়ালের ইটের গাঁথুনিতেও রয়েছে নানা নান্দনিকতার ছাপ। এ দেওয়াল গুলো সহ পুরো মনজিদ পাতলা পাথরের আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে খু্ব নিপুণ কৌশলে। সেই  সেগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কর্তুক সংস্কার করেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে তৎকালীন মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমানে সরকারের উপ-সচিব মোঃ নুরুজ্জামানের সরাসরি হস্তক্ষেপে, তার একান্ত পরিকল্পনা ও জোর প্রচেষ্টায় মসজিদকে নতুন করে সাজাতে ও আর্কষনীয় করে সৌন্দর্য বর্ধণ করে গড়ে তুলতে নানা পরিকল্পণা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ জন্য মসজিদের পূর্বের কমিটির বিলুপ্ত করে নতুনভাবে কমিটি গঠন করে ঠিকাদার শরিফুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন একটি কমিটি গঠন করা হয়। এসময় মসজিদের চতুর্দিকে সুন্দর টাইলস্ দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হয়।  এতে দর্শনার্থীদের ঘুরে ঘুরে মসজিদটি দেখতে খুব সুবিধা হয়। এছাড়া পূর্বপার্শ্বে অবস্থিত দিঘির পাড়ে ফুলের বাগান নির্মাণ ও রাস্তাসহ আলোকসজ্জার কাজ করা হয়। তাছাড়া বিশ্রামাগার সহ পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা শৌচাগার নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। তবে সেটি বন্ধ হয়ে যায় সেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বদলী হয়ে যাবার পরে। 

কালো পাথরে নির্মিত এ মসজিদটি প্রায় ৪৬১ বছরের আগের। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০.৫ ফুট ও প্রস্থ প্রায় ৪৪.৫ ফুট। মনজিদটিতে তিনটি করে দুই সারিতে মোট ছয়টি গোলাকার আর্কষণীয় গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের গায়ে রয়েছে মনোরম লতাপাতার নানা নকশা ও টেরা কাটা।

মসজিদে মাঝের প্রবেশপথের ওপর ফলকে আরবি ভাষায় একটি লিপি লেখা রয়েছে। এর পূর্ব প্রান্তে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে একটি প্রবেশপথ রয়েছে।

মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণের স্তম্ভের ওপর একটি উঁচু আসনও রয়েছে। ধারণা করা হয়, এ আসনে বসেই তৎকালীন কাজী-বিচারকরা এলাকার সব রকম বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।

মসজিদে মোট মিহরাব রয়েছে তিনটি। যার সবগুলো আবার কালো পাথরের তৈরি। মিহরাবে আঙ্গুরগুচ্ছ ও লতা-পাতার নকশা খোদিত করা রয়েছে।

মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাবটি পশ্চিম দিকের দেয়ালের থেকে আলাদা। পশ্চিম দেয়ালের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ও মাঝের প্রবেশপথ বরাবর দুটো মিহরাব রয়েছে। যা মেঝের সমান্তরাল। উত্তর-পশ্চিম কোণের মিহরাবটি শুধু একটি উঁচু বেদীর উপর বসানো।

এছাড়া মসজিদে নারীদের নামাজ পড়ার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।

মসজিদের সামনে রয়েছে বিশাল আকৃতির দীঘি। দিঘীর আয়তন প্রায় ৭৭ বিঘা। এর দৈর্ঘ্য এক হাজার ২৫০ ফুট ও প্রস্থ ৯০০ ফুট। দীঘিটি সুগভীর ও এর জলরাশি স্বচ্ছ। 

কথিত আছে, ‘দীঘির তলদেশে পারদ মিশ্রিত থাকায় পানিতে কচুরিপানা বা অন্য কোনো আগাছা জন্মাতে পারে না’।
দীঘিতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।  দীঘিটি এজন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। ইজারাদাররা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রচুর মাছ চাষ করেন।
এ দীঘিতে নামার জন্য দু’টি দৃষ্টিনন্দন সিড়ি রয়েছে। দীঘির শীতল পানিতে ওজু করেন মুসল্লীরা। আর দর্শনার্থীরা হাতমুখ ধুয়ে দূর করেন ক্লান্তি। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা এখানে গোসলও করে থাকেন।

মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি তেঁতুল বৃক্ষ। শতাব্দী প্রাচীণ এ তেঁতুল বৃক্ষের প্রকৃত বয়স আসলে কত হতে পারে তা কারো পক্ষে ধারণা করা অসম্ভব। হতে পারে ৪/৫ শত বছরের ও বেশি প্রাচীণ। এ তেঁতুল বৃক্ষ কালের স্বাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আজ অবধি। যার ছবি সবাই না উঠিয়ে পারেন না। এ-র নিচে অনেকে বসে আরাম করেন।
এদিকে মসজিদে যাওয়ার প্রায় ৫০০ ফুট আগে রাস্তার ডানপাশে বাক্স আকৃতির একটি কালো পাথর আছে।

কথিত আছে, ‘জনৈক কৃষক হালচাষের সময় জমিতে এ পাথরটি খুঁজে পান। এসময় নাঙ্গলের ফলার আঘাতে কিছুটা ভেঙেও যায়। পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়। উদ্ধারকৃত পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবিতে লেখা রয়েছে, আল মালিকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন। অর্থাৎ শাসক, পরাক্রমশালী ও সম্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হোসেনের ছেলে আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ। এ থেকে বোঝা যায় পাথরখণ্ডটি হুসেন শাহের স্মৃতিবিজড়িত।

এছাড়া কুশুম্বা মসজিদের পশ্চিম পাশে প্রায় ২০০ মিটার দূরে কালের স্বাক্ষী হিসেবে রয়েছে আরো একটি ছোট্ট দীঘি। সেটি  সোনাদীঘি নামে পরিচিত। অনেক দর্শনার্থী এ দীঘির বিষয়টি খুব কমই জানেন । ফলে তারা সোনাদীঘি না দেখেই মসজিদ ও দীঘি দেখেই ফিরে যান।

কথিত আছে, ‘সুলতান আলাউদ্দীন হোসাইন শাহ্ এর সোনা নামের এক আদরের মেয়ে ছিলেন। অকালে তার মৃত্যু হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সুলতান। সে মেয়ের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই সোনাদীঘি খনন করা হয়েছিল’। একটি ছোট্ট দালালের চিহ্ন ও রয়েছে। যা লতাপাতায় পরিবেষ্টিত হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। সেটির তেমন কোন উন্নয়ন ঘটেনি। এ সোনা দীঘির দক্ষিণ পার্শ্বে রয়েছে একটি মাদরাসা। 

 নওগাঁ জেলার অন্যতম ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্র ও দৃষ্টি নন্দনিক কারুকাজ খচিত সৌন্দর্য মন্ডিত এ কুশুম্বা শাহী মসজিদ। এখানে দূর,-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন।  মসজিদ কমিটির সভাপতি ও মান্দা উপজেলার তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুজ্জামান মসজিদটিকে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।তার সেই চেষ্টা আজ সফল ভাবে কাজ করছে। আরো দৃষ্টিনন্দন করা প্রয়োজন। দর্শনার্থীরা মসজিদ ও দীঘি দেখার পর বিনোদনের আর তেমন কোনো জায়গা খুঁজে পায়না। পার্ক থাকলে এ সমস্যা দূর হতে পারত।

মন্তব্যসমূহ (১)


Lost Password