ওসি দুলাল আনোয়ারায় টানা ৫ বছর,পরের গন্তব্য কোথায়

ওসি দুলাল আনোয়ারায় টানা ৫ বছর,পরের গন্তব্য কোথায়
MostPlay

মামুন খাঁন, ক্রাইম রিপোর্টার (চট্টগ্রাম): চট্টগ্রাম রেঞ্জের আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ৫ বছর কাটানোর পর আবারো কোটি টাকার মিশনে পাশের থানায় জেঁকে বসতে চান। অথচ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ওসিরা স্থায়ী পোস্টিং পান না। এরপরেও কিছু ঠুনকো যুক্তি, নির্দিষ্ট এলাকার প্রভাব কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের তদবিরে আনোয়ারা থানায় ৫ বছর ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার অভিযোগ রয়েছে দুলাল মাহমুদের বিরুদ্ধে।

২০১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জের এই পুলিশ অফিসার কর্ণফুলীর পার্শ্ববর্তী আনোয়ারা থানায় যোগদান করেছিলো। একই থানায় গত ৫ বছরে বহু অফিসার পদোন্নতি পেলেও অনেকের বদলি নেই! আবার বদলি আদেশের পরও রহস্যজনক কারণে তা থমকে যায়। আর বহাল তবিয়তে আছেন ওসি দুলালও। যদিও পুলিশ প্রবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, কোনো পুলিশ সদস্য ২ বছরের বেশি এক স্থানে থাকতে পারবেন না। তাহলে কোন খুঁটির জোরে ওসি দুলাল মাহমুদ এতটা বছর একই থানায় কাটাচ্ছেন।

সূত্রে জানা যায়, টেকনাফের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহতের ঘটনার পর কক্সবাজার জেলা পুলিশকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নেয় পুলিশ সদর দফতর। একে একে বদলী হতে থাকে জেলার সব পুলিশ সদস্য ।এমন সংবাদ পেয়ে নড়েচড়ে বসে আনোয়ারা থানার ওসি দুলাল মাহামুদ। তিনি কিছুতেই আনোয়ারা-কর্ণফুলী ছাড়তে চান না। এজন্য তিনি গোপনে কোটি টাকার তদবির মিশনে নেমেছেন। গত সপ্তাহে বেশ দৌঁড়ে কাটিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় থেকে সচিবালয়। তার প্রমাণও প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সুপারিশে আনোয়ারা থেকে এক লাফে চট্টগ্রাম রেঞ্জ জিগবাজি দিয়ে তিনি সিএমপি’র কর্ণফুলী থানায় আসতে যান।

কেনোনা তাঁকে আনোয়ারা ছাড়তে হচ্ছে বিষয়টি ঢের পেয়েই লবিং শুরু করে ওসি দুলাল। যেকোন উপায়ে তিনি কর্ণফুলী বসতে মরিয়া। কারণ আনোয়ারার এক তৃতীয়াংশ জায়গা কর্ণফুলী থানার অধীন। এমনকি আনোয়ারার সাগর উপকূল গহিরা ও কর্ণফুলীর নদী মোহনায় মাদক ব্যবসার রূট তার বেশ চেনা জানা হয়ে গেছে। গোপন সুবিধার কথা কে না জানে। এ জন্যই কি তাহলে কোটি টাকার মিশনে নেমেছেন!

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এক ওসি একই জায়গায় অবস্থান করলে ওই এলাকার অপরাধী এবং প্রভাবশালীদের সঙ্গে এক ধরনের সখ্যতা তৈরি হয়। ফলে বাম হাতে দেওয়া নেওয়ার ঘটনা ও এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা থাকে।যদিও ইতোমধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে আনোয়ারা থানা থেকে ওসি দুলাল মাহমুদ বদলি হয়ে কর্ণফুলীতে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ওসি দুলাল এতটাই ক্ষমতাধর, সে যখন যে থানা চাইবেন সেখানেই দায়িত্ব দিতে হবে। অথচ পুলিশ প্রবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, কোনো পুলিশ সদস্য দুই বছরের অধিক এক স্থানে থাকতে পারবেন না।

অনুসন্ধান বলছে, তৎকালীন বিএনপি সরকার আমলের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ওসি দুলাল মাহমুদ আজ আ'লীগ ঘরনায় বেশ পাকাপোক্ত। অতীতে বহু ওসিরা বিএনপির মতাদর্শে বিশ্বাস করলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এরা রাতারাতি সাইনবোর্ড পরিবর্তন করে নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে প্রচার শুরু করেন। স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের ব্যবহার করেন। এ কারণে ওসি পরিবর্তন করতে গেলেই পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা অনেকটা বেকায়দায় পড়ে যান।

অপরসূত্র বলছে, থানাগুলোর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওসি পদে রাজনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের অসন্তোষ ও অস্বস্তি দীর্ঘদিনের। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ওসি হওয়ার মূল যোগ্যতাই হচ্ছে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ। স্বাভাবিকভাবেই এ পন্থায় নিয়োগ পাওয়া ওসিরা কারও নির্দেশ মানতে চান না। তাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সহজে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। দিনের পর দিন তাঁরা একই থানায় কাটিযয়ে দেন। এমনকি রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে ওসিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব কঠিন। তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মানতে চান না। আবার ওসি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও আরো বহু কথা শোনা যায়।

অনুসন্ধান বলছে, আনোয়ারা থানায় দীর্ঘ সময় থাকা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এসআই একরামুজ্জামান ৫ বছর, এসআই শামশুজ্জামান ৫ বছর। ওসি দুলাল মাহমুদ ও ৫ বছর। এরা তিনজনেই সিন্ডিকেট যোগসূত্র। এদের আলাদা করা অসম্ভব। আনোয়ারায় এরা বহু ক্ষমতাধর।এভাবে বছরের পর বছর একই অঞ্চলে ওসি ও পুলিশ সদস্যদের থাকা যৌক্তিক কি না, সে প্রশ্নের উত্তর যদিও অজানা। তবে স্বয়ং পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন এভাবে একই এলাকায় থাকার কারণে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে অসাধু পুলিশের সখ্যতা গড়ে ওঠে।

ওসি দুলাল বহু তাজা ওয়ারেন্ট তামিল না করে মাসিক হারে অপরাধীদের পকেট কাটেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। একই কায়দায় মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যু, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তাদের মাধ্যমে অর্থ বিত্তের পাহাড় গড়েছেন নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে । সুযোগের সন্ধানে আবারো তাই কর্ণফুলী থানায় যেতে তদবির করছেন। ওসি দুলালের প্রশ্রয়ে আনোয়ারায় সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা একের পর এক অপরাধ করলেও বরাবরই থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। থানায় সালিশ বাণিজ্য, খুন, ধর্ষণ, মাদক কারবার কিংবা যে অপরাধই হোক না কেন সন্ত্রাসীদের মধ্যস্থতায় হয় টাকার বিনিময়ে। সব কিছুরই সমাধান করতেন ওসি দুলাল।

অপরদিকে, ওসির সঙ্গে অপরাধীদের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি এলাকায় ওপেন সিক্রেট হওয়ায় নির্যাতিত হয়েও ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ দিতে সাহস পায়নি। ফলে অনেকেই হারিয়েছেন বহু জমিজামা আর সম্পদ। বহু হিন্দু পরিবার অত্যাচারে ঘর ছেড়েছে পালিয়েছে,চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, সাধারণত এক স্থানে দুই বছরের বেশি সময় না থাকার যে প্রশাসনিক নীতি রয়েছে, তা উপেক্ষিত হতে পারে দুই কারণে। প্রথমত, দলীয় আনুগত্য, দ্বিতীয়ত অর্থের বিনিময়। স্পষ্টত একটি বাহিনীর কর্মকর্তার বেলায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে এক জায়গায় থাকার জন্য নিয়ম যখন লঙ্ঘিত হয়, সেটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি তা নিশ্চিত।

সেক্ষেত্রে আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশন মহানগর কমিটির সাঃ সম্পাদক মোঃ নাছির উদ্দিন মোল্লা বলেন, পুলিশের মতো একটি সংবেদনশীল বাহিনীতে এটা অবশ্যই অনিয়ম। অতীতে একই স্থানে তিন বছরের বেশি সময় পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তারা অবস্থান করতেন না। তবে সা¤প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে ওসি দুলালের মতো দলীয় এবং আঞ্চলিকতার প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একই স্থানে অবস্থান করছেন একাধিক ওসি। এটা কোনোভাবেই পুলিশ বাহিনীর জন্য শুভকর নয়। এর ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করলে সেখানে শেকড় বিস্তার ঘটবে এটাই স্বাভাবিক।'



ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কিছু চিহ্নিত সোর্সের মাধ্যমে ওসি দুলাল নিয়মিত মাদক কারবারীদের কাছ থেকে মাসোহারা নিতেন। অপরাধীদের সাথে কথা বলতেন পুলিশের অন্যান্য অফিসারদের মোবাইল ফোন থেকে। অভিযোগ রয়েছে কেবল দালাল নয়, থানার বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, হত্যা মামলার আসামি ও মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্য ছিল ওসি দুলাল মাহমুদের। বহু মাদকের আসামিকে ওয়ারেন্ট থাকা সত্বেও টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এছাড়াও বিগত সময়ে বিএনপি জামায়াত-শিবির কর্মীদের ধড়পাকড়ের নামে অর্থ বানিজ্য হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ ছিলো ওসি দুলালের বিরুদ্ধে।

বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে, ওসি দুলালের এসব নানা অপকর্মের ফিরিস্তি যখন বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার হাতে ওঠে আসছে, তখনই পাশের কর্ণফুলী থানায় ওসি হিসেবে বদলি নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বিষয়টি ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি মোঃ আনোয়ার হোসেন ও সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর এর কান পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে জানা যায়।অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আনোয়ারা থানার ওসি দুলাল মাহমুদ বলেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমি অন্য জায়গায়  বদলি হবো কি, হবো না সেটা আমার পুলিশ বিভাগ দেখবে। বদলির বিষয়ে আমি কিছু জানি না ।

জেলা পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক বলেন, আনোয়ারা থানার ওসির বিরুদ্ধে এ ধরনের কোন অভিযোগ থাকলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। তবে মানুষের সাথে পুলিশের সখ্যতা বাড়াতে আরো আন্তরিকভাবে কাজ করছে পুলিশ।চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোঃ আনোয়ার হোসেন জানান, কক্সবাজার জেলা পুরোটার পুলিশে পরিবর্তন করা হয়েছে। এটি নিয়মিত বদলির অংশ বলে উল্লেখ করেন ডিআইজি। ধারাবাহিকভাবে চট্টগ্রাম জেলায়ও তার প্রভাব শুরু হয়েছে।
 

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password