দুনিয়া কাঁপানো প্রেম আর নেই

দুনিয়া কাঁপানো প্রেম আর নেই
MostPlay

বড়জোর সাড়া জাগানো ব্রেক আপ আর রোমাঞ্চকর কেচ্ছা। অথচ অগুন্তি প্রেমের কবিতা এখনও লেখা হয়। সব মিলিয়ে প্রেম আজ ধূসর। যেটুকু চমক, তা জীবনের নিজস্ব। আড়াই দশক পর প্রথম প্রেমিকের সঙ্গে দেখা হলেও সময়টাকে একটুও রঙিন লাগে না।

ভ্যালেন্টাইনস ডে কথাটা তখনও কানে শুনিওনি, যখন ভ্যালেন্টাইনস ডে কথাটা প্রথম চোখে দেখলাম। একটা হলুদরঙা আর্চিসের কার্ডের ওপর সবুজ দিয়ে লেখা ‘ইউ আর মাই ভ্যালেন্টাইন’। সেটা ১৯৯১ সাল। সামনে ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল। জানুয়ারিতেই প্রথম প্রেমে পড়েছি। যে সাক্ষাতে প্রেমের সূচনা, সেই সাক্ষাতের পর মাত্র একটাই চিঠি লিখে উঠতে পেরেছি ছেলেটিকে। ছেলেটির একটা ছবি চুরি করেছি তার দিদার অ্যালবাম থেকে। কত কত জামাকাপড়ের ভাঁজের তলায় রাখা থাকে সেই ছবি।

মাঝে মাঝে বার করে দেখি। তখনই বিডিটাইপ প্রত্রিকা পোস্ট এডিটে কোনও আমেরিকান স্টেটের ছাত্র আন্দোলন নিয়ে বেরনো একটা লেখা চোখে পড়ল। লেখার সঙ্গে যে ছবিটা ছাপা হয়েছিল, তার একেবারে সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে ছেলেটাকে হুবহু আমার সদ্য প্রেমিকের মতো দেখতে! এখানে বলে নিই, আমার প্রথম প্রেমিক আমার একটু দূর সম্পর্কের মাসতুতো দাদা। বয়স কুড়ি, ছ’ফুট লম্বা, ছিপছিপে, কেমিস্ট্রি অনার্স, চোখ দুটো ভীষণ ঝকঝকে, সোনালি ফ্রেমের চশমা পরে, আর কথা কম বললেও যা বলে মেক সেন্স। আনন্দবাজারে ছাপা ছবিটাকে যেন আমার সদ্য প্রেমিকের একটা এক্সটেনশন মনে হল। যেন হ্যাঁ, ও-ও তেমনই এক যুবক যে একটা ছাত্র আন্দোলনকে সামনে থেকে লিড করতে পারে। যার ভেতর বিপ্লব আছে, আদর্শ আছে। এ সব গুণ আমার প্রেমিকের মধ্যে ছিল না। কিন্তু বাঘ যেমন মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে মানুষখেকো হয়ে ওঠে, বার বার লোকালয়ে হানা দেয়, মানুষের মননও সে রকম এক অদ্ভুত অতর্কিত বাঘ। কাব্য, সাহিত্য, শিল্প, ডিপ থিঙ্কিং, মননশীলতা— এ সবের আস্বাদ এক
বার পেয়ে গেলে বাকি সব ধরনের জীবন বড় সাদামাটা লাগে!

সদ্য দোয়ানো দুধের মতো ‘র’, জৈবিক, গভীর অথচ মনগড়া এক ভালবাসা তৈরি হল আমার মধ্যে। তখন আমি জীবনানন্দমুখী একটা মেয়ে, নিজেও এক জন কবি। তখন আমার দু’-দুটো খাতা ভর্তি কবিতা। সে এক বিস্ময়কর সম্পদ। এবং সেই সব কবিতার শরীরে কত কাটাকুটি, তবু আরও কাটাকুটি করতে ইচ্ছে হয় বিকেল হলে, আমার বিকেলগুলো সবচেয়ে রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে কবিতার শব্দ বদলানোর কাজে। আমি সারাক্ষণ বই পড়ি, আমি সবচেয়ে ভালবাসি কবিতার বইয়ের রিভিউ পড়তে, ভাল ভাল লাইন টুকে রেখে দিই। বাঙালি কবিরা— সুনীল, সুভাষ, অরুণ মিত্র, তারাপদ, শক্তি, শরৎ, অমিতাভ গুপ্ত— যে ভাবে, যে কায়দায় তখন কবিতা পড়তেন, আমি নিজের কবিতা নিজের জন্য ওভাবেই পড়ি।

আধুনিক কবিতার সম্ভব, অসম্ভব নিয়ে আর পাঁচ জনের মতো আমি বোকা বোকা প্রশ্ন করি না। আমি তখনই জানি যে, কবিতাকে শুরু থেকে আসলে মেনে নিতে হয়, কারণ কবিতার সঙ্গে জীবনে কখনও শত্রুতা হয় না। ফলে আমি যে কখনও প্রেমিক খুঁজে পাব না, আমি যে জীবনভর প্রেমিক তৈরি করে নেব একটা রাস্তা তৈরি করে নেওয়ার মতো, এটাই বোধহয় স্বাভাবিক ছিল। এবং সেই প্রথম প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটল। ‘আমারি চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ’—এর মতো আমার প্রেমিক হয়ে গেল আমার কল্পনার বিপ্লবী। মননশীল, সাহসী, সম্ভাবনাময়, ভাবুক, রোমান্টিক এবং আদর্শ প্রেমিক। এ সবই আমার মনে মনে ঘটে গেল, কারণ ওর সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ কিছুই হত না, আর ফোন-টোনও তখন ছিল না।

আমি পাতার পর পাতা চিঠি লিখতাম। এক দু’-পাতার উত্তরও আসত। অবশ্য এ সবের আগেই আমি বিডিটাইপ প্রত্রিকা পোস্ট এডিটের ওই লেখাটা কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়ালে সেঁটে দিয়েছি। সবাই দেখল, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। জানি না কে কী ভেবেছিল, কিন্তু আমি জানি আমি কেন করেছিলাম এটা। প্রেম জিনিসটা আত্মপ্রকাশ চায়, প্রেমে পড়লে মানুষ প্রেমিকের কথা বলতে চায় সবাইকে। যে কোনও বয়সেই প্রেমে গাম্ভীর্য বজায় রাখা কঠিন, একটা না একটা মানুষ লাগেই যার কাছে গদগদ হয়ে বলা যায় প্রেমিকের কথা। বিশুদ্ধ প্রেমে এ উচ্ছ্বাস হয়। আমরা কেন প্রেম করি, কেন কারও প্রেম চাই, কেন কাউকে কামনা করি, কাউকে নিজের করে ফেলি, জড়িয়ে নিতে চাই— এই গদগদ আবেগে কান পাতলেই সেটা পরিষ্কার বোঝা সম্ভব। এবং প্রেম হওয়া আর সম্পর্ক হওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সেই বয়েসে প্রেম হয়। সম্পর্ক হয় না।

সম্পর্ক হয় অনেক পরের কোনও একটা বয়েসে। সম্পর্কের কথা মানুষ গোপন রাখতে পারে। বা অন্যকে বলার মতো সেখানে কিছু না-ও থাকতে পারে। প্রেমের ক্ষেত্রে তা হয় না। প্রেম হাতে ধোয়া পোশাকের মতো, নিংড়ে মেলে দিলেও টপ টপ করে জল ঝরবেই। আমার দূর সম্পর্কের মাসতুতো দাদার সঙ্গে প্রেমে, দেয়ালে সেঁটে দেওয়া কাগজটা ছিল কারও কাছে না প্রকাশ করতে পারা আবেগ থেকে ঝরতে থাকা অদৃশ্য জল। এ রকম সময়েই ফেব্রুয়ারির এক মেঘলা বিকেলে কেন কে জানে পাড়া থেকে বেরিয়ে বাগবাজারের কাছে একটা কার্ডের দোকানে ঢুকে কার্ড দেখতে শুরু করেছিলাম।

দেখতে গিয়ে পেলাম ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ লেখা কার্ড। কৌতূহলবশত দোকানের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের কার্ড? সে বলল, প্রেম দিবসের কার্ড। আমি ভয়ঙ্কর অবাক হয়ে ভাবলাম, পৃথিবীতে এ রকম প্রেমের দিবস বলে কিছু আছে না কি! সত্যি, বলতে ১৪ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে আমার এটুকুই সম্পর্ক। জীবনে এই দিনটা সে ভাবে পালন করার সুযোগ হয়নি। আর দিন পালনে আমি বরাবরই তেমন আগ্রহী নই।

সে দিন দশ টাকা দিয়ে কার্ডটা কিনে এনেছিলাম। বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি ডিকশনারি দেখে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র অর্থ খুঁজে বার করলাম।

পাখিদের মিলনের দিন, সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এগজ়িকিউশনের দিন, এ রকম কিছু লেখা ছিল। অনেক বছর পর চসারের ‘ভ্যালেন্টাইন’ কবিতাটা সুযোগ হল পড়ার। পাখিদের মতো মানুষেরও যে নিজের সঙ্গী খুঁজে নেওয়ার অধিকার আছে, টু চুজ় অর নট টু চুজ়-এর অধিকার আছে বা এক জনকে গ্রহণ করে পরে তাকে ত্যাগ করার অধিকার আছে, এ সব তখন আমার অবশ্য অন্য ভাবেই জানা হয়ে গেছে।

সব প্রেমই আস্তে আস্তে নিজের মতো করে একটা প্রতিশ্রুতির চেহারা খুঁজে নেয়, পেয়ে যায় চিরকালীন প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র। হ্যাঁ, বিয়ের মতো প্রেমেরও একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে।

তুমি আমার/ আমি তোমার, ধ্যানজ্ঞান তুমি, সারা জীবন তোমাকেই ভালবাসব, তোমাকেই চাইব, শরীর মন সব তোমাকেই দেব— এটাই প্রেমের প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা। এই নিবেদনটাই অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আমাকে শুধু তোমার জন্য বসিয়ে রাখে, কাঁদায়, হাসায়, উৎফুল্ল করে, পাগল করে, বিষণ্ণ করে, আত্মবিশ্বাস তৈরি করে বা নষ্ট করে দেয়। হঠাৎ ভাঙা হাট করে দেয় চারপাশ। এমনকি মেরেও ফেলতে পারে আমার এই ‘তোমাকে ভালবাসি’ বোধ। ওর সঙ্গে আমার প্রেমও ধীরে ধীরে এ রকম একটা শেপ পেয়ে গেল। দেখা হয় না, কথা হয় না, অথচ সারাক্ষণ প্রেমে ডুবে আছি। সেই আমাদের এক পাড়াতুতো দাদুর মতো, যাঁর ঘরে ইলেকট্রনিক্স তানপুরা সারাক্ষণ ছাড়া থাকত। আমার প্রেমটা আমার কানের কাছে তেমনি বাজত সারাদিন।

১৯৯২-এর শেষে গেছিলাম হরিদ্বার এবং আরও কিছু জায়গা, যেমন মথুরা, বৃন্দাবন। তখন দিল্লিতেও অনেক দিন ছিলাম। এই টানা দেড় মাস বা তার অধিক সময় যে কলকাতার বাইরে ছিলাম, সমানে ঘুরছি, নতুন নতুন জায়গা দেখছি, অথচ আমার মন পড়ে আছে কলকাতায়। কারণ আর কিছুই নয়, চিঠি লিখতে পারছি না, চিঠি পাচ্ছি না। হর কি পৌরি ঘাটে সন্ধ্যারতির সময় গিয়ে দাঁড়াই। সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা হতে চেষ্টা করি। কারণ চিন্তা করার সুখ অল্প বয়সেই পেয়ে বসেছে। এখন কেমন হয়ে গেছে হর কি পৌরি ঘাট জানি না, তিন দশক আগে সন্ধেবেলা আরতির সময় লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত ঘাটটা। শত শত ঘণ্টা বেজে উঠত, প্রজ্বলিত প্রদীপে ভরে যেত নদীবক্ষ। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে জয়ধ্বনি উঠত শিব-পার্বতীর নামে।

হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইত ভক্তরা। সেই ডিসেম্বরের ঠান্ডায় কোনও মতে ঘাটে একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেলে সমে ফিরে ফিরে আসা হারমোনিয়ামের সুর শুনতে শুনতে আর ভেসে ভেসে দূরে চলে যাওয়া প্রদীপের দিকে তাকিয়ে আমি অধীর হয়ে উঠি আমার প্রেমিকের জন্য। আমি ছিলাম আমার প্রেমের ভক্ত। সত্যিকারের ভক্তের মতোই আমি ভক্তিতে নিস্পন্দ হয়ে যেতাম। ধর্মসঙ্গীতে একই পঙ্‌ক্তি বার বার গাইতে গাইতে মানুষ একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। হর কি পৌরি ঘাটের সেই বৃন্দগানে আমি আমার মতো করে ডুব দিতাম নিজের চেনা নামসুতো ধরে। চারপাশটা মুছে যেত। মনে হত যেন, নিজের চেতনা থেকে বেরিয়ে গেছি। এ রকম আমার পরেও হয়েছে। আমার প্রেমিক আমি অনেক বার তৈরি করে নিয়েছি।

যেমন কত বার আমার ঈশ্বরও আমিই তৈরি করে নিয়েছি। আপ্লুত হতে পারার মধ্যেই যে প্রেমিক বা ঈশ্বর থাকে, এ সব তখনও পুরোটা বুঝিনি। বুঝতে সময় লেগেছে। এ ঈশ্বর মানে নিঃস্বতা, নিঃসঙ্গতা। প্রেমিক আর ঈশ্বরের মধ্যে সে দিক থেকে পার্থক্য একটাই। একটা আছে বলে আবেগটা আছে। অন্যটা নেই বলে আবেগটা আছে। সেই জন্যই দ্বিতীয়টায় মন বসানো কঠিন। কী করে সম্ভব হয়েছিল জানি না, এত অল্প বয়সেই প্রেমে আমি ‘স্যালভেশন’ দেখতাম। প্রেম মানেই কষ্ট পাওয়া বুঝতাম। প্রেম মানে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে একটা হাসিখুসি মেলামেশা, এটা আমি কখনও ভাবতে পারতাম না। আমি এ রকম চাইতামও না নিজের জন্য।

প্রেম, বিষাদ আর মেলানকলির প্রতি আমার নিজস্ব টান ছিল। এর অনেক পরে নিটশে পড়ে বুঝলাম, আমাদের প্রেম, বিষাদ, মেলানকলির প্রকৃত উদ্দেশ্য মৃত্যুকে অনুভব করা। সে যা-ই হোক, এই সব প্রচ্ছন্ন, ঝাপসা কিছু উপলব্ধি নিয়ে আমি কলকাতা ফিরলাম। এবং এখন বুঝি যে, প্রেম জিনিসটা আমাকে কখনও আনন্দ দেয়নি। আমাকে লিবারেট করেনি। প্রেম একটা বোঝা হয়ে বুকে চেপে বসে থেকেছে। কেউ যদি বলেন যে, প্রেম মানে ‘অ্যাবানডান্স অব জয়’ আমি বুঝব না। প্রেম মানে আমার কাছে চার কিলোমিটার রাস্তা মরুভূমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে এক কুম্ভ জল আনতে যাওয়া! ব্যাপারটা কঠিন। বেশি প্রেমে পড়লে ভীষণ মাথাও ধরে যায়।

এই কারণে প্রেম নিয়ে আমাকে কিছু লিখতে হলে আমি ভয়ঙ্কর ভয় পেয়ে যাই। মনে হয় আমি এক চির-অন্ধ পুরোহিত, যে সব সময়ই প্রেমে ‘স্টেপ ওভার’ করে ফেলেছে। যতটুকু জীবনের পাঁচ আঙুলে ধরা যায়, তার বেশি অনুভব করে ফেললে মুশকিল তো হবেই।

সে দিনই পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’ আবার উল্টে পাল্টে পড়ছিলাম।

‘তুমিও কি আমার সর্বনাশ করনি নন্দিনী?

আগে গোলমরিচের মতো এতটুকু ছিলাম আমি।

আমার এক ফোঁটা খাঁচাকে তুমিই করে দিয়েছ লম্বা দালান।

আগাছার জমিতে বুনে দিয়েছ জ্বলন্ত উদ্ভিদের দিকচিহ্নহীন বিছানা।

এখন ঘরে টাঙানোর জন্যে একটা গোটা আকাশ না পেলে

আমার ভালো লাগে না।

এখন হাঁটা-চলার সময় মাথায় রাজছত্র না ধরলে

আমার ভালো লাগে না।

পৃথিবীর মাপের চেয়ে অনেক বড় করে দিয়েছ আমার লাল বেলুন।

গোলমরিচের মতো এই একরত্তি পৃথিবীকে

আর ভালো লাগে না আমার।’

ওহো! আমাদের প্রেমের পুরনো ট্রাঙ্ক খুললে ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা এ রকম সারি সারি কথোপকথন চোখের সামনে খুলে যাবে। যদিও সেই তিরিশ বছর আগেই ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’-র রোমাঞ্চের সঙ্গে আমার প্রজন্মের পরিচয়, কিন্তু আমরা খুব যে গোলাপ আর কার্ড জেনারেশন, তা বলা যায় না। বরং এখনকার হিসেবে প্রেমের ক্ষেত্রে আমরা হলাম ‘ভারবিয়েজ’ প্রজন্ম।

প্রেমকে প্রমাণ করার চেষ্টায় আমরা কত যে অতিমানব হতে চেয়েছি! তাই বোধহয় এখনও এই তিরিশ বছর পরও ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ বিষয়টা আমাদের হ্যাবিট হয়ে উঠতে পারেনি। যাদের পেরেছে, তারা প্রেমকে সঙ্গ আর সম্পর্ক হিসেবে দেখেছে। এখন আমাদের সময় থেকে আরও তিরিশ বছর এগিয়ে মানুষ প্রেমের ব্যাপারে যেন অনেকটাই ‘ইউজ়ড টু’। আমার এও মনে হয় এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রেমটা যেন ঠিক দু’জনের মধ্যেও হয় না। পার্কের বেঞ্চের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোতেও এখন একটা বিরাট সমাজ ঢুকে পড়ে প্রতিটি সম্পর্কে। সাক্ষী থাকে। সেলাম করে। সেই ভ্যালিডেশন ছাড়া

এখন একটা গোলাপও কেউ কাউকে দেয় কিনা সন্দেহ! এবং প্রেম জিনিসটা এখন আগের মতো গোপনীয়ও নয়, ব্যক্তিগতও নয়। মোহ নিজেই কেমন মোহহীন, অনাড়ম্বর। জগদ্বিখ্যাত প্রেম এখন আর হয় না। এখন জগদ্বিখ্যাত ব্রেকআপ আর স্ক্যান্ডাল হয়। তার পরেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে নোংরামি হয়। যদিও অগুনতি প্রেমের কবিতা এখনও লেখা হচ্ছে। কিন্তু সেই সব কবিতার একটাকেও বালিশের মতো আঁকড়ে মাথা গুঁজে দিতে ইচ্ছে করে না। প্রেমের কবিতা পড়ে এখন মনে হয়, প্রেমের ক্যারিকেচার বা কার্টুন, কমিক স্ট্রিপ।

ফিটজ়েরাল্ড আর জেলডা, সার্ত্রে আর সিমোন, টেড হিউস আর সিলভিয়া প্লাথ, কিংবা এলিয়ট আর ভিভিয়ান, জীবনানন্দ, শোভনা, লাবণ্য ত্রিকোণ, এঁরাই আমাদের সময়ের প্রেমের রুপোলি ঘোড়া। বিয়াত্রিচ বা নোরা বার্নাকেল, মির্চা এলিয়াদের জন্য পাগল মৈত্রেয়ী, রুপাই আর সাজুর অবিনশ্বর প্রেম, এমনকি এই সে দিন পর্যন্ত অমিত আর বন্যা— এ যুগের মিডিয়োক্রিটির কাছে এ সব মহৎ প্রেম ধূসর হয়ে গেছে। নিজেরাই নিজেদের চমকে দিতে পারার মতো প্রেম আর আমরা এখন কেউই করছি না।

এখন অবশিষ্ট যেটুকু চমক, তা জীবনের নিজস্ব।

আমার সেই প্রথম প্রেম ভেঙে গেছিল দু’যুগেরও বেশি আগে। ঠিক ২৬ বছর পর, গত বছর ফেব্রুয়ারির শেষে মেসেঞ্জারে টেক্সট ঢুকল, “কেমন আছিস? পারলে ফোন করিস। এই হল নম্বর।” দেখলাম ও! আমার প্রথম বয়ফ্রেন্ড।
আমার দাদা। যার আটশো টাকার টিউশনির রোজগারে আমার ভাগ ছিল ছ’শো। তখন রাত দশটা। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম। ছাব্বিশ বছর পর কথা হল আমাদের। ও বলল, “এখন আসতে পারি তোর কাছে? যদি অসুবিধে না থাকে।”

বললাম, “হ্যাঁ এসো।” কিন্তু নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল
না যেন।

রাত এগারোটায় আমাদের কমপ্লেক্সের গেটের সামনে ওর সঙ্গে দেখা হল আমার। ২৬ বছর পর। ২৬ বছর সময়টাকে মনে হল এক মুঠো ঠান্ডা বালি। গেট দিয়ে তখনও ক্রমাগত গাড়ি ঢুকছিল, বেরোচ্ছিল। গাড়ির লাল আর হলুদ আলো পড়ছিল ওর মুখে। ভেঙে পড়া চোখমুখ। ওর মা, মানে আমার মাসি মারা গেছে বলে ও কলকাতায় এসেছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে ঠিক নিজের মধ্যে নেই। মায়ের সঙ্গে শেষ দেখাটা হয়নি। আমি ৪৬। ও ৫০। আমরা গম্ভীর দুটো চির-পরিচিত মানুষ। মাঝখানে শোক। তাই সময়টাকে একটুও রঙিন লাগল না, মায়াবী লাগল না, আশ্চর্যান্বিত দেখাল না রাতটাকে, ধুম উঠল না বুকে, কাঁপল না চোখের পাতা। আমরা পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। তখনই হঠাৎ ও আমাকে বলল, “মিথ্যে কথা বলিস না, তুই চলে গেলি কেন সত্যি বল? আর ক’টা দিন অপেক্ষা করতে পারলি না? আমি তো ৯৫-এর মার্চেই চাকরি পেয়ে গেলাম!”

একটু নার্ভাস হয়ে আমি বললাম, “তুমি কি খুব দুঃখ পেয়েছিলে?” ছাব্বিশ বছর পর এই প্রশ্ন করার সময় আমার মনে হল যে, জীবন আমাকে এ রকম একটা প্রশ্ন করার সুযোগ দেবে, কখনও ভাবিনি। আমার মনে হল এই সুযোগ পাওয়াটাই তো একটা প্রেমের জয়। একটা গোটা তিরিশ বছর সময় সঙ্কুচিত হয়ে যে এ রকম একটা মুহূর্ত তৈরি হল, এই তো অনেক! হৃদয়ে প্রেম নিঃশেষ হয়ে গেলেও মানুষ বোধহয় এই সব মুহূর্তের লোভ কাটিয়ে উঠতে পারে না!

ও দাঁড়িয়ে পড়ল আমার কথা শুনে। বলল, “কষ্ট হয়েছিল মানে? এখনও তো কষ্ট হয়।”

ছাব্বিশ বছর পর ওর মুখ থেকে এটা শুনে আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ও বলল, “বল, শুনি, কী এমন পেলি ছেড়ে এসে? সত্যি বলিস। মিথ্যে কথা শোনার জন্য আসিনি।”

আমি স্বীকার করলাম।

সত্যি বলতে তেমন কিছুই না।

পরের দিন আমি চলে গেলাম ঢাকায়। আর ও ফিরে গেল বিদেশে, যেখানে ও থাকে। তার পরই লকডাউন। প্যানডেমিক। ইংল্যান্ডে মানুষ মরতে লাগল হাজারে হাজারে। এবং অদ্ভুত, কী অদ্ভুত ভাবে কোভিড সংক্রমণের সাত দিনের মাথায় ও-ও চলে গেল প্রবল শ্বাসকষ্ট নিয়ে। হাসপাতালে কেউ আর ওকে দেখতেও পেল না। যে রাতে
ওর সেরিব্রাল হল, সে দিন সন্ধেয় প্রচণ্ড নিঃশ্বাসের কষ্ট নিয়েও ফোন করেছিল আমাকে। বলেছিল, “দ্যাখ, কী যে হচ্ছে আমার, কিছু বুঝতেই পারছি না।”

মাঝের সময়টায় আমরা কিন্তু কেউ কারও দিকে ঝুঁকিনি। বলা যায় আমাদের পুরনো প্রেমের আবেগটা থেকে আমরা বরাবরের মতো আলাদাই হয়ে গেছিলাম। ছাব্বিশ বছর পর দেখা হওয়ার সময়ও আমি এত অবাক হইনি। যতটা অবাক হলাম ওর মৃত্যুর পর। আর যেটা আসলে বলছিলাম, এই অবাক হওয়ায় আমাদের নিজেদের খুব একটা হাত ছিল না। প্রেম আমরা আর কতটুকু করে উঠতে পারি? প্রেম আমাদের দিয়ে যারপরনাই করিয়ে নেয় জীবন।

সেই জন্য ক্ষয় হয়ে যাওয়ার পরও এক একটা প্রেমকে সময়ের আলো, অন্ধকারে কখনও কখনও অফুরন্ত দেখায়। “বোধহয় শেষ এক বার দেখবে বলেই অত রাতে ছুটে এসেছিল,” বলছিল কেউ। আমি এ সব বিশ্বাস করি না। কিন্তু এ যদি অন্য কারও গল্প হত, হয়তো শুনতে শুনতে গলা বুজে যেত কান্নায়। হয়তো তার হাতটা ধরে একটু রেগে ভর্ৎসনা করে আমিই বলতাম, “তোমার মতো সবাই নয়,এ বার বুঝেছ?”

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password