যেভাবে আটক হয় আকবর: রহিমের মিথ্যাচারে দেশ জুড়ে তোলপাড়

যেভাবে আটক হয় আকবর: রহিমের মিথ্যাচারে দেশ জুড়ে তোলপাড়
MostPlay

সিলেটের আলোচিত রায়হান হত্যা মামলার প্রধান আসামী এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া পুলিশের পাতানো ফাঁদে আটক হয়েছে। কিন্তু তার এ আটক নিয়ে পরবর্তী জনমনে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ বলছে পুলিশ, আবার কেউ বলছে রহিম নামের এক যুবক তাকে আটক করেছে।এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কিছু অনলাই মিডিয়ায় ভুল তথ্য প্রকাশ করে জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। গতকাল মঙ্গলবার সরেমজিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আকবর গ্রেফতারের আসল কাহিনী। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণে জানা যায় রায়হান হত্যার পর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আকবর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে পালিয়ে চলে যায়।

সেখান থেকে চলে যায় আসাম প্রদেশের শীলচর শহরের অদূরে অবস্থিত গুমড়া নামক এলাকায় এবং আশ্রয় নেয় গোপাল নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে। সেখান থেকে গোপালের মাধ্যমে আসামের রাজধানী গোয়াহাটিতে নিরাপদে বসবাসের জন্য এসআই আকবর সিন্ধান্ত নেয়। এদিকে আকবরের অবস্থানের উপর কঠোর নজরদারী ছিল সিলেট জেলা পুলিশের। একপর্যায়ে পুলিশ তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জানতে পারে আকবরের ভারতে অবস্থানের কথা। এরপর আকবরের আশ্রয়দাতা গোপালের পিছনে কয়েকজন বিশ্বস্থ সোর্স লাগিয়ে দেয় পুলিশ।

এতে মোটা অংকের বিনিময়ে আকবরকে কৌশলে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সোর্সরা গোপালকে কাবু করে নেয়। এদিকে আকবর গোয়াহাটিতে যাওয়া জন্য ব্যাকুল। তাই গোয়াহাটিতে পৌঁছে দেয়ার জন্য আকবর গোপালের সাথে এক লক্ষ টাকার চুক্তি করে এবং সেই অনুযায়ী আশ্রয়দাতা গোপাল দিনক্ষণ ঠিক করে গত রবিবার রাতে আকবরকে গোয়াহাটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অভিজিৎ নামের এক চালকের এলট্রো কার ভাড়া করে। কিন্তু তারা পুলিশের পরিকল্পনা অনুযায়ী আকবরকে গোয়াহাটিতে না নিয়ে কৌশলে মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী সেনা রোড দিয়ে উখিয়াং পেট্রোলপাম্পের কাছে রবিবার রাত ৩টায় পৌঁছায়।

তখন কানাইঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ শামসুদ্দোহা পিপিএম আসামী আকবরকে লোভা সীমান্ত দিয়ে উদ্ধারের জন্য লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউপির এক জনপ্রতিনিধি সহ কানাইঘাটের বাসিন্দা সালেহ আহমদ ও শাহাব উদ্দিনের সহযোগিতা চায়। এতে শাহাব উদ্দিন ও সালে আহমদ দনা সীমান্তবর্তী এলাকার রহিম উদ্দিন নামের আরেকজনকে সঙ্গীয় করে নেয়। তারা রবিবার থেকে কানাইঘাট থানা পুলিশের সাথে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় ঘোরেন। একপর্যায়ে রবিবার রাত ২টার দিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মাধ্যমে পুলিশের কথামতো গোপালের হাত থেকে আকবরকে নিয়ে আসার জন্য বিশ্বস্থ কয়েকজন গারোকে উখিয়াং পাঠানো হয়।

কিন্তু সেখানে যোগাযোগ বিচ্ছিহ্ন থাকার কারনে পাঠানো গারো দলটি আকবরের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। পরে আকবরকে সেখান থেকে বাংলাদেশে কি ভাবে নিয়ে আসা যায় তার জন্য পুলিশ সালেহ আহমদ ও শাহাব উদ্দিনকে জানায়। এতে সালেহ আহমদ ও শাহাব উদ্দিন কুলিয়াং বস্তির উয়েস নামের এক খাসিয়া যুবকের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তাদের কথামতে উয়েস সহ কয়েকজন খাসিয়ারা রবিবার ভোররাতে উখিয়াং পেট্রোলপাম্প নামক স্থান থেকে আকবরকে গোপালের কাছ থেকে বুঝে নেয়। এরপর উয়েস বাংলাদেশে অবস্থানরত সালেহ আহমদ ও শাহাব উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করে। সেই যোগাযোগ অনুযায়ী সোমবার সকাল ৮টায় বহিস্কৃত এসআই আকবরকে ভারতের দনা খাসিয়া বস্তিতে নিয়ে আসে উয়েস।

তখন কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ থানার ওসি সহ পুলিশের একটি দল দনা সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নেয়। এবং আকবরকে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে আসার জন্য তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এতে সালেহ আহমদ, শাহাব উদ্দিন ও দনা সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা রহিম উদ্দিন বাংলাদেশ সীমান্তের ১৩৩৫নং পীলারের কাছে যায়। পরে দনা খাসিয়া বস্তি থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে আকবরকে নিয়ে আসার জন্য রহিম উদ্দিন সহ ৪/৫জনকে দনা খাসিয়া বস্তিতে পাঠানো হয়। সেখানে উয়েস সহ ভারতের দনা বস্তির খাসিয়াদের কাছ থেকে আকবরকে বুঝে নেয় রহিম উদ্দিন সহ কয়েকজন যুবক। ঐ সময় খাসিয়ারা আকবরের বেশ কয়েকটি ভিডিও ধারন করে, যা পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

এর মধ্যে একটি ভিডিওতে শুনা যায়, রহিম উদ্দিন এক খাসিয়া ব্যক্তির মোবাইল থেকে সীমান্তে অবস্থানরত সালেহ আহমদকে ফোনে জানান, ওসি স্যারকে বলেন আকবর আমার কাছে আছে। ভিডিওতে রহিম খাসিয়াদের বলে, কানাইঘাট থানার ওসি ও নানকা চেয়ারম্যান আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। এরপর রহিম উদ্দিন সীমান্তের ১৩৩৫নং পীলারের পাশে অবস্থানরত শাহাব উদ্দিন ও সালেহ আহমদের কাছে নিয়ে আসে আকবরকে। সেখানে তারা আকবরকে সাথে নিয়ে একটি ছবি তুলে ফেসবুকে ছেড়ে দেন। পরে সোমবার দুপুর ১টার দিকে দনা সীমান্তের ভিতরে আকবরকে নিয়ে আসলে সেখানে পূর্ব থেকে অবস্থানরাত কানাইঘাট থানার ওসি শামসুদ্দোহা পিপিএম ও জকিগঞ্জ থানার ওসি নাসির আহমদ, চেয়ারম্যান জেমস্ লিও ফারগুসন নানকার উপস্থিতিতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

কিন্তু বরখাস্তকৃত এসআই আকবরকে ভারতে আটক করে কৌশলে বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা ব্যয় করেছে বলে জানা গেছে। এতে সফল হয় পুলিশের সমস্ত পরিকল্পনা। কিন্তু এখন রহিম উদ্দিন কিছু গণমাধ্যমে বলছে সে নাকি খাসিয়াদের কাছ থেকে তার আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে আকবরকে আটক করেছে এতে পুলিশের কোন হাত নেই।

তার এমন হাস্যকর কথায় জনসাধারণের মধ্যে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সচেতন মহল জানিয়েছেন যেখানে রহিম নিজে একটি ভিডিওতে সালেহকে বলছে ওসি স্যারকে বলো আমি আকবরকে হাতে পেয়েছি। এখন সে নানা ধরনের মিথ্যা কথাবার্তা বলে যাচ্ছে। রহিম উদ্দিনের এমন বক্তব্যের রহস্য জানতে চাইলে বেরিয়ে আসে নানা পুরষ্কারের লোভনীয় কাহিনী। মঙ্গলবার সরেজমিনে রহিমের মন্তব্য জানার জন্য তার বাড়ি সহ দনা সীমান্ত এলাকা দিনভর খোঁজে তাকে পাওয়া যায়নি, এমনকি তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে তার সাথে থাকা অপর দুইজন শাহাব উদ্দিন ও সালেহ আহমদ জানিয়েছেন, গত রবিবার রাত থেকে তারা সহ রহিম উদ্দিন একসাথে কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ থানার ওসির সাথে ছিলেন। কিন্তু তাদেরকে রায়হান হত্যা মামলার আসামী আকবরকে গ্রেফতারের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি, শুধু তাদের বলা হয়েছে ভারত থেকে একজন লোককে নিয়ে আসতে হবে। সেই অনুযায়ী থানা পুলিশের দিকনির্দেশনা মতে কানাইঘাটের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় গিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত দনা সীমান্তে আকবরকে নিয়ে আসা হয়।

এতে আমরা সহ রহিম উদ্দিন পুলিশকে শুধু সহযোগিতা করেছি, কিন্তু রহিম উদ্দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কথা বলেছেন তা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তকর। এটা লোভনীয় ছাড়া আর কিছু নয়।

এদিকে রহিম উদ্দিনের মিথ্যাচারের বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করলে রবিবার থেকে সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত রহিম উদ্দিনের অবস্থানের কয়েকটি সিসি টিভির ফুটেজ ও ছবি সংগ্রহ করা হয়। ভিডিওতে দেখা যায় রহিম উদ্দিন, শাহাব উদ্দিন ও সালেহ আহমদ রবিবার রাত থেকে সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তারা কানাইঘাট থানার ওসি শামসুদ্দোহা পিপিএম ও জকিগঞ্জ থানার ওসি নাসির আহমদের সাথে কানাইঘাটের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরছেন।

রায়হান হত্যা মামলার প্রধান আসামী বহিস্কৃত এস.আই আকবরকে গ্রেফতারের বিষয়ে থানার ওসি শামসুদ্দোহা পিপিএম এর সাথে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন পিপিএম স্যারের চৌকশ নেতৃত্বে নানা ধরনের পন্থা ও কৌশল অবলম্বন করে আকবরকে আটক করেছে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকের সহযোগিতা নিয়েছি। আকবরকে আটকের বিষয়ে আইনি জটিলতা থাকার কারনে এর বাইরে কিছু বলা যাচ্ছে না। এ প্রতিবেদনটির প্রমাণ স্বরূপ সম্পূর্ণ ভিডিও তথ্য প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password