কটকটি বিক্রিতে ফেরিওয়ালাদের হারিয়ে যাওয়ার গল্প

কটকটি বিক্রিতে ফেরিওয়ালাদের হারিয়ে যাওয়ার গল্প
MostPlay

কটকটি রাখবেন কটকটি। লোহা-লক্কর, খালি বোতল, ভাঙাচোরা টিন-প্লাস্টিক দিয়ে রাখবেন কটকটি’— প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি ও পাড়া-মহল্লায় ফেরিওয়ালাদের এমন ডাক শোনা যেত একসময়। সেই ডাক শুনে শিশুরা ঘরের পুরোনো মালামাল ও খালি বোতল নিয়ে ছুটে যেত কটকটি কিনতে। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে ‘কটকটি’ নামক মুখরোচক খাবারটি। দুই দশক ধরে পাড়া-মহল্লায় এখন আর শোনা যায় না কটকটি ফেরিওয়ালার সেই ডাক।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই শতাধিক পরিবার কটকটি বিক্রির পেশায় জড়িত ছিল বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে জেলার আশুগঞ্জের তারুয়া, সরাইলের টিঘর, সদর উপজেলার রাধিকা, ভাদুঘর, খাঁটিহাতা এলাকার বেশিরবাগ মানুষ কটকটি বিক্রির পেশায় জড়িত ছিল।

এখন কটকটির ফেরিওয়ালার সন্ধান পাওয়া অনেকটা দুষ্প্রাপ্য। উন্নতমানের গুড় না পাওয়ায় কটকটি বানানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন তারা।

আশুগঞ্জের তারুয়ায় উত্তরপাড়ায় কটকটি বিক্রি পেশায় জড়িত ছিল প্রায় ৩০ পরিবার। এখন দু-একজন ছাড়া কাউকেই কটকটি ফেরি করতে দেখা যায় না। তারা এখন পুরোনো প্লাস্টিক ও টিনের বিভিন্ন মালামালের বিনিময়ে কটকটির পরিবর্তে আচার, বুট-বাদাম, পেঁয়াজ ও শনপাপড়ি ফেরি করে বিক্রয় করেন।

তারুয়া উত্তরপাড়ার মোহাম্মদ খসরু মুন্সি প্রায় দুই যুগ আগে কটকটি বিক্রি করতেন। তার বাড়িতেই ছিল কটকটির কারখানা।

তিনি বিডি টাইপকে বলেন, ‘প্রতিদিন প্রায় ৭-৮ মণ গুড়ের কটকটি তৈরি করা হতো বাড়িতে। তখন আমার অধীনে ১৭ ফেরিওয়ালা বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বিক্রি করতেন। মাস শেষে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো আয় হতো।’

তিনি বলেন, ‘উন্নতমানের গুড় না পাওয়ায় এ পেশা সবাই ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ ভালোমানের গুড় ছাড়া কটকটি তৈরি হয় না। এখন যে গুড় পাওয়া যায়, তাতে চিনির মিশ্রণ থাকে। আমিও এ পেশা ছেড়ে এখন কৃষিকাজে মনোযোগ দিয়েছি।’

একই কথা বলেন গ্রামের ফেরিওয়ালা জাকির ভূঁইয়ার স্ত্রী আয়েশা বেগম ও সাধন ভূঁইয়ার স্ত্রী আঙ্গুরা বেগম। তারা বিডি টাইপকে বলেন, ‘ভালো গুড় এখন মেলে না, যা পাওয়া যায় তাতে চিনি থাকে। চিনি থাকলে কটকটি সহজে জোড়া নেয় না। আমরা বাড়িতে বরইসহ বিভিন্ন আচার বানিয়ে দিলে তারা (স্বামীরা) ফেরি করে বিক্রি করেন।

একই গ্রামের বৃদ্ধ অলি মিয়া এখনো বাড়িতে কটকটি বানিয়ে ফেরি করে নিজেই বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আগে ভালোমানের গুড় পাওয়া যেত, তাই কটকটির মানও ভালো হতো। কটকটির চাহিদাও আগের মতো নেই। প্রতিদিন মাত্র দেড় কেজি গুড়ের কটকটি তৈরি করি।’

তিনি বলেন, ‘গরমে এর চাহিদা একটু বাড়ে। কারণ গরমকালে অনেকেই মিনারেল ওয়াটারের বোতলের পানি পান করেন। সেই বোতল দিয়ে ছেলেমেয়েরা কটকটি কেনে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালাচ্ছি।’

এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মনির হোসেন বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর আগে আমরা গ্রামীণ নানান রকমের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ খাবারের অংশ ছিল কটকটি। তখন দেখতাম কটকটিওয়ালারা সুরে সুরে কটকটি বিক্রি করতেন। আমরা ধান-চাল দিয়ে কটকটি কিনে খেতাম। স্কুলে গিয়েও কটকটি খেয়েছি। আমাদের মা-চাচিরাও গর্ভবতী হওয়ার পর এই কটকটি খেতে পছন্দ করতেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত দুই দশকে এ খাবারটি চোখে দেখিনি, সেখানে আমার সন্তানের তো এই কটকটির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এমন হাজারও সংস্কৃতি আমাদের বাঙালিয়ানা থেকে বিদায় নিচ্ছে। আমরা আধুনিক যুগে প্রবেশ করে এ সংস্কৃতিগুলো মেরে ফেলেছি।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password