বিড়ালের মা আলেপা

বিড়ালের মা আলেপা
MostPlay

৪১ বিড়ালের ‘মা’ আলেপা। কথাটি শুনে চমকে ওঠার কিছু নেই। তিনি বিড়ালের জন্ম দেননি। তবে তার পোষা বিড়ালগুলোকে তিনি সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি ওদের মা’। আলেপা খাতুন পাবনার চাটমোহর পৌরসভার ৪, ৫, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী আসনের পরপর দু-বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। অতি সাধারণ একজন মানুষ।

জীবনে পশুপ্রেমটাই তার কাছে বড়। বেশ ভূষায় কোনো মোহ নেই। করতেও পছন্দ করেন না। অতিসাধারণ জীবন যাপন করেন। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া দুই শতক জায়গায় কুঁড়ে ঘরে ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। ভোর থেকেই শুরু হয় তার কর্মব্যস্ততা। তবে এ কর্মব্যস্ততা একটু অন্যরকম। কারণ ৪১টি বিড়ালের ভরণপোষণ যে তাকে করতে হয়। সাংসারিক অবস্থা ভালো না আলেপার। কোনো মতে চলে সংসার। তারপরও তিনি ৪১টি বিড়ালের অন্ন জুগিয়ে চলেছেন। এ জন্য একামাত্র ছেলে মহরমের কাছ থেকেও টাকা নিতে হয়। 

আত্মকেন্দ্রিক সমাজে পশু প্রেম উদার মনের পরিচয়ই বহন করে। আলেপার সঙ্গে কথা বলার জন্য তার বাড়িতে প্রবেশ করতেই কানে আসে বিভিন্ন নামে ডাকাডাকি। প্রথমে মনে হতে পারে কোনো মানুষকে তিনি ডাকছেন। ভেতরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় আসল ব্যাপার। মা’র ডাকে যেমন সন্তানরা ছুটে আসে, তেমনি আলেপার এমন মধুর ডাকে একের পর এক বিড়ালগুলো ছুটে আসে তাদের মা’র সাজানো খাবার খেতে।

মা’র ডাকে যেমন সন্তানরা ছুটে আসে, তেমনি আলেপার এমন মধুর ডাকে একের পর এক বিড়ালগুলো ছুটে আসে তাদের মা’র সাজানো খাবার খেতে। চোখ জুড়িয়ে যাবে একেক জনের জন্য একেকটা থালায় থরে থরে সাজানো মাছ-ভাত দেখে। এ সময় আলেপা বলছেন, ‘বাবা কনে গেছিলা, বাবা ভাই কনে? খাও বাবা খাও।’ কোন হিংসা বা মারামারির বালাই নেই। বিড়ালগুলো আপন মনে খেয়ে চলে তাদের ‘মা’র হাতের সাজানো খাবার। 

আলেফা বলেন, আমিই ওদের মা। আমি ছাড়া ওদের দেখপি কে? প্রতিদিন আড়াই কেজি চালের ভাত আর সঙ্গে ৮০-৯০ টাকার মাছ লাগে আমার এসব ছেলে-মেয়েদের জন্য। এখন এদের সংখ্যা বাচ্চাসহ ৪১টা। এর আগে আরো বেশি ছিলো কিন্তু কুকুর মেরে ফেলেছে বেশ কিছু। এছাড়া ছিলো বেজি। কিন্তু মানুষ সেগুলোকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে। টাকি মাছ বেশি পছন্দ করে ছেলেগুলো। তিনি বলেন ‘ওরা খায় সিলবার কাপ ও লোয়ারি মাছ। ছোট মাছ কম খায়। দিনে ৫-৬ বার খাবার দিতে হয়। রাতে উয়্যারে জন্যি ভালোভাবে ঘুমাতেও পারি না। মারামারি লাগলি আমার ঘুম থেকে উঠে গিয়ে উয়েরেক শাসন করা লাগে। তখন ওরা মারামারি বন্ধ করে। আবার শাসন করলি উয়্যারা পা চ্যাপা ধরে। উয়েরে জন্যি আলাদা বাসন-কোসন। আলাদা রান্না করি। মসলা কম কম দেয়া লাগে। বেশি মসলা দিলে উয়্যারা খাবার পারে না।’ 

মারামারি লাগলি আমার ঘুম থেকে উঠে গিয়ে উয়েরেক শাসন করা লাগে। তখন ওরা মারামারি বন্ধ করে। আবার শাসন করলি উয়্যারা পা চ্যাপা ধরে। প্রতিদিন খরচ কত হয় জানতে চাইলে আলেফা বলেন, ‘আড়াই কেজি চালের ভাত, এক পোয়া দুধ ও মাছ লাগে। তাতে ২৫০ টাকার নিচে হয় না। আমার ঘরেই ওরা থাকে। মেঝেতে বিছানা প্যাড়া দিই। মশারি টাঙ্গায়া দিই। ছোটবেলা থেকেই আমি এসব ভালোবাসি। ওরা অবলা প্রাণি।

উয়েরে জন্যি ভীষণ  মায়া লাগে আমার। উয়েগারে ছ্যাড়া আমি থ্যাকপার পারবো না। রাত ২টা পর্যন্ত জাগা লাগে উয়েগারে লাগে। বেড়ায় বাড়ি বাড়ি। উয়েগারে শুয়ায়ে তারপর আমি শুই। আমি খাবার লিয়ে গেলি তবে ওরা খায়। আর কারো তা খায় না। ওরা পশু হলিও সব বুঝে। ওরা সব বুঝে। খালি মানুষই মানুষকে ভালো বুঝে না। ভালো চায় না। স্বামী-সন্তানদের কথা জিজ্ঞেস করতেই এবার একটু আবেগী হয়ে ওঠেন আলেপা খাতুন। তিনি বলেন, ‘বাপ-মা ছোট কালে বিয়্যা দিছিলো। সংসার কি জিনিস বুঝবার পারি নাই।

৩০ বছর আগে গর্ভে সন্তান থাকতেই স্বামী আমাকে ছ্যাড়ে চলি যায়। ছেলে মহরম এখন রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। কয়েক বছর আগে ছাওয়ালের বিয়্যা দিছি। আছি উয়েরেক নিয়্যাই থাহি। সবাই আমাক ভালোবাসে। ভোট দিল মেলা করে। কাউন্সিলর হতে পারছিলেম মানসির ভালবাসায়। বিড়ালগুলোর থাকার জন্যি একটা ঘর হলে ভালো হয়, কিন্তু টাকা পাবো কনে? উয়েরেক খাওয়াবো না ঘর বানাবো! এভাবেই আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলেন আলেপা খাতুন। 

প্রতিবেশীরা সবাই সমান মনের না। আলেপার বিড়াল নিয়ে সংসার, অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেন। মাঝে মধ্যে এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বিবাদও হয়। সেটাও ঝামেলার বিষয়। তবুও তিনি সব কিছু উপেক্ষা করে তার সন্তানদের (বিড়াল) অন্ন জুগিয়ে চলেছেন। 

কথা হয় দোলবেদীতলার সমাপ্ত কর্মকার, সন্দ্বীপ কর্মকারের সঙ্গে। তারা বলেন, আলেপা আপা খুব সাদামাটা জীবন যাপন করেন। প্রতিদিনই আমাদের সঙ্গে দেখা করেন, খোঁজ খবর নেন। এছাড়াও কোনো বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে বা মারা গেলে সবার আগে পৌঁছে যান ‘আমাদের আলেপা আপা। চাটমোহর পৌর সদরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও তার প্রতিবেশী রাজ আলী বলেন, ছোটবেলা থেকেই আপাকে দেখে আসছি। তার এই পশুপ্রেম দেখে আমরা মুগ্ধ।

অনেক কষ্টে চলে তার সংসার। কিন্তু কোনো সময় কাউকে তিনি তা বুঝতে দেন না। বিড়ালগুলোই তার সবকিছু। মানবাধিকার কর্মী ড. শাহনাজ পারভীন জানান, মানুষ মানুষের প্রতি আজকাল সহনশীল নয়। সেখানে সাধারণ প্রাণির প্রতি এমন নির্মোহ ভালোবাসা নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password