সোলাইমানি হত্যার পেছনে কি ইসরায়েল!

সোলাইমানি হত্যার পেছনে কি ইসরায়েল!
MostPlay

ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে ইঁদুর-বিড়াল খেলা হচ্ছে। কৌশলী বিড়ালের সামনে ধাড়ি ধাড়ি ইঁদুর ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বিড়াল সেই ইঁদুর ধরেও ফেলছে। কিন্তু ফাঁদে পা দিচ্ছে না। ইরানকে যুদ্ধে জড়ানোর চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। মেজর জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা সেই চেষ্টারই অংশ। সোলাইমানিকে হত্যার পরপরই ইসরায়েলের তৎপরতা বেড়ে যায়। হামলা করল যুক্তরাষ্ট্র, হত্যার শিকার ইরানি জেনারেল আর যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব ইসরায়েলের। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গ্রিস সফর সংক্ষিপ্ত করে তেল আবিবে ফিরে আসেন। ইসরায়েলজুড়ে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। পশ্চিমা–নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমও দিনভর নানা ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করে দেখানোর চেষ্টা করল, যুদ্ধ লাগতে আর কত দেরি। কিন্তু এসবের বিপরীতে ইরানের প্রতিক্রিয়া ছিল কৌশলী ও সংযত। কিছুটা হুমকি-ধমকির সঙ্গে প্রথাগত কূটনীতিক বক্তব্য দিয়েই ইরান তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

সারা বিশ্বেই আলোচিত এক সামরিক চরিত্র ছিলেন জেনারেল সোলাইমানি। আফগানিস্তান থেকে লেবানন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁর সামরিক পরিকল্পনার প্রকাশ ছিল। হাজি কাশেম নামে পরিচিত এই জেনারেল তাঁর ব্যতিক্রমী সমর–কৌশলের জন্য দ্রুতই পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন ফ্রন্টে গিয়ে সরাসরি মিলিশিয়াদের সঙ্গে কথা বলতেন। কখনো কখনো যুদ্ধও করেছেন। মার্কিনদের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ২৭ মিলিয়ন মুসলমান নিহত হয়েছে বলে সাম্প্রতিক এক হিসাবে বলা হয়েছে। ২৭ মিলিয়ন শহীদের সঙ্গে সোলাইমানির নামও যুক্ত হলো। সন্দেহ নেই, সোলাইমানির হত্যা ইরানের জন্য বড় ধাক্কা কিন্তু অপূরণীয় ক্ষতি না।

মার্কিনদের শুরু করা সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই নিজেই এখন সন্ত্রাসী রূপ ধারণ করেছে। আল–কায়েদা ও আইএসকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সন্ত্রাসীদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। সোলাইমানি ছিলেন সেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াইয়ের এক নেতা। প্রতিরোধ জনযুদ্ধের অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নেতৃত্বের স্থান কখনো শূন্য থাকে না। তাই সোলাইমানির অনুপস্থিতি মার্কিনবিরোধী জনযুদ্ধকে খুব বেশি দুর্বল করবে বলে মনে হয় না, বরং শক্তি জোগাবে। মনে হতে পারে ইরানের ক্ষতি হয়ে গেল। কিন্তু এত দিন ইরান চলমান যুদ্ধে সাফল্য উপভোগ করেছে। সুবিধা না করতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র শেষ আঘাত হানার চেষ্টা করছে। ইরান ও তার মিত্রদের ওপর এ ধরনের আরও হামলা, হত্যা যুক্তরাষ্ট্র করতে পারে।

শুধু সোলাইমানিই নন, ইরানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন মার্কিন-ইসরায়েলের গোয়েন্দারা। এর আগে ইরানের বেশ কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে পঙ্গু করে দেওয়া। কিন্তু এসব হত্যাকে সামাল দিয়ে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ঠিকই চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইরান সোলাইমানির হত্যাকেও ভালোভাবেই সামলে নেবে।

সোলাইমানির ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলে নাখোশ হওয়ার বড় কারণ তিনি সিরিয়ায় আইএসকে কঠোরভাবে দমন করেছেন। যে কারণে সিরিয়ায় আইএসকে পরাজিত ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র আবু বকর আল বোগদাদিকে হত্যা করতে বাধ্য হয়। তা না হলে আইএস আরও কিছুদিন সক্রিয় থাকলে সন্ত্রাস দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় আরও কিছুদিন যুদ্ধ করতে পারত। আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস দমনের যে মধুচন্দ্রিমা উপভোগ করেছে, সিরিয়ায় এসে তা বাধাগ্রস্ত হয়। এর জন্য সোলাইমানিকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, উভয়েই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বেকায়দায় আছেন। অভিশংসনের মুখে পড়েছেন ট্রাম্প। সামনেই যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন আছে। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় ভাটার টান লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্যদিকে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়া দুজনের জন্যই জরুরি ছিল। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর সাধারণ শত্রু হচ্ছে সোলাইমানি। তিনি মাঝেমধ্যেই ইরাক ও সিরিয়া সফর করে থাকেন। তিনি অনেক দিন ধরেই মোসাদের হত্যাতালিকায় ছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি আগ্রহী ছিল না সোলাইমানিকে হত্যায়। তবে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে সোলাইমানি হত্যায় নিয়োজিত করতে ইসরায়েলি লবি সফল হয়েছে।

এ ছাড়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার অভিযোগ তদন্ত করছে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)। আইসিসি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আমলে নেওয়ার পরই দেখার বিষয় ছিল ইসরায়েল কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানায়। আইসিসির প্রসিকিউটরকে অ্যান্টিসেমেটিক, হলোকস্টের সমর্থক, হামাসের এজেন্ট—বিভিন্ন কথা বলে ইসরায়েল পরিস্থিতি সামালের চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু এটা ইসরায়েলে সহজাত প্রতিক্রিয়া না। ইসরায়েল সাধারণত কোনো হামলার মাধ্যমেই প্রতিক্রিয়া দেওয়ার চেষ্টা করে। এবার সোলাইমানিকে হত্যা করেই দিল। হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে মার্কিন প্রশাসন সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা বললেও এর পেছনে ইসরায়েলকেই মূল ইন্ধনদাতা হিসেবে মনে করা হয়।

সর্বোপরি ছায়াযুদ্ধ থেকে যে করেই হোক ইরানকে বের করে আনতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। কারণ, ছায়াযুদ্ধে কোনোভাবেই ইরানের সঙ্গে তারা পেরে উঠছে না। একাধিক ময়দানে ইরানের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ লড়ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। এই ছায়াযুদ্ধ করে ইরান এখন একেবারেই ইসরায়েলের ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে। আগে লেবাননের হিজবুল্লাহদের দিয়ে ইসরায়েলকে ঘায়েলের চেষ্টা করছে ইরান। এখন ইরাকও যেহেতু অনেকটাই ইরানের নিয়ন্ত্রণে, ফলে ইরান সরাসরিই ইসরায়েল সীমান্তে পৌঁছে যাবে। সাদ্দাম হোসেনের আমলে ইরানকে বিকল্প পথে হিজবুল্লাহর কাছে পৌঁছাতে হতো।

ইরাক থেকে সাদ্দাম হোসেনকে হটিয়ে নিজেদের অজান্তেই সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সবচেয়ে উপকার করে দিয়েছে। সাদ্দাম হোসেন কখনোই ইরানের বন্ধু ছিলেন না। ইরাক দখল করে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা হয়েছিল, ইরানের কাছাকাছি চলে এসেছি। শত্রুর কাছে যাওয়া মানে নিজেকেও শত্রুর কাছে নেওয়া, সেটা যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারেনি। বরং শত্রুর শত্রুকে নির্মূল করে গোটা ইরাককেই ইরানের নিয়ন্ত্রণে তুলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর সিরিয়ার যুদ্ধ ইরানের জন্য নতুন সুযোগ করে দিয়েছে। সিরিয়াতেও ইরান সফল। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের লক্ষ্যই হচ্ছে, যেকোনোভাবে ইরানকে তার নিজের সীমান্তে ফিরিয়ে নেওয়া। এর জন্য প্রয়োজন সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করা। যুদ্ধ বাধলে ইরান নিজের সীমানা রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের আয়াতুল্লাহদের আরও একটি উপকার করেছে। আয়াতুল্লাহ–নিয়ন্ত্রিত ইরানের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ে পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের যে প্রশ্ন রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের আচরণের কারণে তা আড়াল হয়ে যাচ্ছে। বরং ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা নিজ নিজ দেশে কমলেও দখলদারি, আগ্রাসন, নির্বিচারে গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় কর্তৃত্ববাদী আয়াতুল্লাহদের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। মধ্যপন্থীরা ইরানের রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যে তথাকথিত গণতন্ত্রকামীদের দিয়ে মিছিল–সমাবেশ করিয়ে, সবুজ শার্ট পরিয়ে আয়াতুল্লাহদের নাড়িয়ে দেওয়া চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু এখনো সফলকাম হতে পারেনি পশ্চিমারা।

তাই অনেকটা মরিয়া হয়েই ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। ইরানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই উসকানি অনেক দিনের। ১৯৮৮ সালেও ইরানের যাত্রীবাহী বিমানে হামলা করে ২৯০ জনকে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরান সেবারও ফাঁদে পা দেয়নি। এবারও দেবে বলে মনে হয় না। ইরান প্রথমে যেটা করবে তা হলো, প্রভাবিত করে ইরাকের সংসদে মার্কিন সৈন্য বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাস করানো। ইরাকের সংসদে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত পাস হলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইরাকে সৈন্য রাখা কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ফ্রন্টে মিলিশিয়াদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর হামলা বৃদ্ধি করবে। যেমন ইরাকের মার্কিন দূতাবাসে ফের হামলা হয়েছে। সোলাইমানির হত্যাকাণ্ড হামাস-হিজুল্লাহসহ অনেককেই ক্ষিপ্ত করেছে। তৃতীয়ত, ইরান চেষ্টা করবে তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের চাপে ফেলা। তেল–রাজনীতিতে ইরান রাশিয়া, চীন, ভারতসহ ইউরোপের অনেক দেশকেই পাশে পেতে পারে। তাই সরাসরি যুদ্ধের চেয়ে ছায়াযুদ্ধ ইরান ও সোলাইমানি উভয়কে নতুন করে জনপ্রিয় করে তুলবে। মার্কিন-ইসরায়েল জুটি নানাভাবে সোলাইমানিকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছে। শিয়া-সুন্নির বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে সোলাইমানিকে সুন্নি গণহত্যার নেপথ্য নায়ক বলে চিহ্নিত করে যুক্তরাষ্ট্র সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হিতে বিপরীতই হয়েছে। সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, নিকট অতীতে কোনো সামরিক জেনারেলের মৃত্যুর পর এমনটা হয়নি। শিয়া-সুন্নির বিভাজনকে অতিক্রম করে হাজি কাশেম বিশ্বের কাছে এক প্রতিরোধ জনযোদ্ধার নামে পরিণত হয়েছেন।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password