বার্সেলোনা–পিএসজি: মহারণে কার কৌশল কেমন হবে

বার্সেলোনা–পিএসজি: মহারণে কার কৌশল কেমন হবে
MostPlay

বার্সেলোনা–পিএসজির মহারণ আজ। এক দল বছরের পর বছর ধরে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার চেস্টা করেও পারছে না, গতবার ব্যর্থ হয়েছে একদম ট্রফি–ছোঁয়া দূরত্বে এসে। ফাইনালে উঠে হেরেছিল বায়ার্ন মিউনিখের কাছে। আরেক দল মাঠ ও মাঠের বাইরের হাজারো সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে পাখির চোখ করেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়কে। বিশ্বজোড়া লাখ লাখ ফুটবলপ্রেমীদের চোখ আজ সেঁটে থাকবে তাই টিভি পর্দায়।

মাঠের ভেতরের লড়াইয়ে এই দুই দলের ইতিহাস সমৃদ্ধ। শেষবার এই দুই দল যখন চ্যাম্পিয়নস লিগে মুখোমুখি হয়েছিল, সেবার এই পিএসজিকেই অবিশ্বাস্যভাবে হারিয়ে পরের রাউন্ডে উঠেছিল বার্সা। ৪-০ গোলে প্রথম লেগ হারের পর সব অনুমান, পর্যালোচনা, ভবিষ্যদ্বাণীকে ঠুনকো বানিয়ে দ্বিতীয় লেগে ৬-১ গোলের জয় তুলে নিয়েছিল কাতালান ক্লাবটি। এর ‘প্রতিশোধ’ পিএসজি নিয়েছিল মাঠের বাইরে। অর্থবিত্তের ক্ষমতা দেখিয়ে বার্সায় বিখ্যাত ‘এমএসএন’ ত্রয়ী ভেঙে দলে ভিড়িয়েছিল নেইমারকে।

যে নেইমার আবার এই দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন। বার্সার হয়ে যে খেলোয়াড়টি বছরের পর বছর ধরে গলার কাঁটা হয়ে যন্ত্রণা দিচ্ছিল, সে খেলোয়াড়টিকে দলে ভিড়িয়ে ইউরোপীয় আধিপত্যের স্বপ্ন দেখা শুরু করে প্যারিসের দলটি।

চার বছর পর পেছন ফিরে তাকালে কী দেখা যায়? পিএসজি কি স্বপ্নপূরণের তৃপ্তি পেয়েছে? উত্তর হবে, না। ওদিকে বার্সাও সেবার ইউরোপসেরা হওয়ার পর মাঠ ও মাঠের বাইরে নানা কারণে শুধু নিচের দিকে নেমেছে, বিশেষ করে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায়। আজকের ম্যাচটা তাই দুই দলের কাছে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার লড়াইও।খুঁজে পাওয়ার সে লড়াইয়ে দুই দলের কৌশল কেমন হতে পারে? আসুন, দেখে নেওয়া যাক:

বার্সেলোনা

কোচ রোনাল্ড কোমানের অধীনে কয়েক মাস আগেও যে ছন্নছাড়া অবস্থা ছিল দলটার, সেখান থেকে অনেকটাই উঠে এসেছেন মেসিরা। বার্সেলোনা নামের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ নৌকাকে এখন অনেকটাই স্থিতিশীল করে এনেছেন এই ডাচ কোচ। লিগের শুরুটা বেশ খারাপ হলেও টানা ১২ ম্যাচ অপরাজিত থেকে উন্নতির আশা করছে বার্সা। যদিও মাঝে সুপারকোপা ও কোপা দেল রে–এর অপ্রত্যাশিত কিছু পরাজয় বার্সেলোনার সামর্থ্যে একটু সন্দেহের কালিমা লাগিয়েছে।

সবকিছু মিলিয়ে একটু আশা, একটু নিরাশার দোলাচলেই চলছে বার্সার মৌসুম। এ মৌসুমে মেসিরা একটা বড় স্বস্তি পেতে পারেন, যদি পিএসজির মতো দলকে হারানোর আনন্দ পেতে পারেন।

কাগজে-কলমে গত কয়েক বছরে পিএসজি কখনোই চ্যাম্পিয়নস লিগে টপকাতে পারেনি বার্সেলোনাকে। এর আগে নকআউট রাউন্ডে দুই দল যে তিনবার মুখোমুখি হয়েছে, প্রত্যেকবারই পরের রাউন্ডে উঠেছে বার্সেলোনা। তথ্যটা কোমানকে যথেষ্ট শান্তি দেবে, উদ্বুদ্ধ করবে—এ ম্যাচ জিততে। আর এ জেতার জন্য কোমানের কৌশল হতে পারে ৪-৩-৩ ছক।

মৌসুমের শুরু থেকে ৪-২-৩-১, ৩-৪-৩, ৪-৪-২ বিভিন্ন ছকে দলকে খেলালেও অবশেষে বার্সেলোনার সেই চিরপরিচিত ৪-৩-৩ ছকে এসেই থিতু হয়েছেন কোমান। এই ম্যাচেও সেটার ব্যতিক্রম হবে না। নেইমার না থাকলেও এ ম্যাচে কৌশলগত ক্ষেত্রে কোমান এমন কিছু বড় পরিবর্তন আনবেন না, যে কারণে মেসি-গ্রিজমানদের খাপ খাওয়ানোর জন্য বাড়তি চিন্তা করতে হয়।

গোলপোস্টের নিচে যথারীতি দলের মূখ্য গোলরক্ষক মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন থাকছেন। স্টেগেনের সামনে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে জুটি বাঁধার জন্য কোমান কাদের নির্বাচন করেন, সেটা একটা বেশ বড় প্রশ্ন। দুই সেন্টারব্যাক জেরার্ড পিকে ও রোনালদ আরাউহো দুজনই চোটে। তবে বার্সেলোনার সমর্থকদের জন্য আশার কথা, পিকে অনুশীলনে ফিরেছেন। গতকাল পিএসজির বিপক্ষে ম্যাচের আগে দলের সঙ্গে পূর্ণ অনুশীলনে ফিরেছেন পিকে।

ওদিকে দেখা যায়নি আরাউহোকে, অর্থাৎ ব্যাপারটা মোটামুটি নিশ্চিত, এই মৌসুমে আলো ছড়ানো উরুগুইয়ান সেন্টারব্যাক এই ম্যাচে খেলছেন না। তবে পিকে অনুশীলনে ফিরলেও, বর্ষীয়ান এ সেন্টারব্যাককে সুস্থ হওয়ার পরপরই মাঠে নামানোর ঝুঁকি কোমান নেবেন কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন।

সেটা আবার পিএসজির মতো কঠিন এক ম্যাচে। অন্তত একজন সেন্টারব্যাকের জায়গা নিশ্চিত। তিনি ফরাসি সেন্টারব্যাক ক্লেমঁ লংলে। লংলের সঙ্গী হিসেবে পিকে থাকেন, না স্বদেশি স্যামুয়েল উমতিতি, না অস্কার মিঙ্গেসা—দেখার বিষয় সেটাই। নিশ্চিতভাবেই পিএসজির আক্রমণভাগের বাঁ দিকে খেলবেন ফরাসি স্ট্রাইকার কিলিয়ান এমবাপ্পে। নেইমারহীন পিএসজির আক্রমণভাগের সবচেয়ে বড় অস্ত্র এমবাপ্পেকে আটকানো যে বার্সা রক্ষণভাগের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, সেটা না বলে দিলেও চলছে।

সে লক্ষ্যে সবচেয়ে বড় কাজটা করতে হবে বার্সেলোনার রাইটব্যাককে। এখন রাইটব্যাক হিসেবে অতি আক্রমণাত্মক ডাচ রাইটব্যাক সের্হিনিও দেস্ত খেলবেন, না তুলনামূলকভাবে রক্ষণে বেশি মনোযোগী মিঙ্গেসা—সেটাও একটা বড় প্রশ্ন হয়ে থাকবে কোমানের মাথায়।

দেস্ত খেললেও, স্বাভাবিকভাবেই নিজে আক্রমণ করার পাশাপাশি এমবাপ্পেকে চোখে চোখে রাখতে হবে তাঁকে। লংলের মতো বাঁ দিকে স্প্যানিশ লেফটব্যাক জর্দি আলবার জায়গা নিশ্চিত।

মিডফিল্ডে কোমান হয়তো খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাবেন না। ডাচ মিডফিল্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, স্পেনের অভিজ্ঞ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার সের্হিও বুসকেতস ও দলে নতুন আসা পেদ্রির ওপরেই মৌসুমের অধিকাংশ সময়ে ভরসা রেখেছেন, এ ম্যাচেও হয়তো এই তিনজনকেই দেখা যাবে মূল একাদশে।

এর আগে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংকে আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে ভাবা হলেও, একাদশে সের্হিও বুসকেতসের জায়গা নিশ্চিত করার জন্যেই হোক, কিংবা আক্রমণভাগে ডি ইয়ংয়ের বল পায়ে কুশলী ভূমিকার সুবিধা নেওয়ার জন্যেই হোক, এই ডাচ মিডফিল্ডার খেলছেন একটু ডান দিকে, একটু সামনে।

আয়াক্সের ডি ইয়ংয়ের সঙ্গে বার্সার এই ডি ইয়ংকে মেলালে চলবে না। আয়াক্সে মূলত ৪-২-৩-১ ছকে খেলা ডি ইয়ংয়ের মিডফিল্ড সঙ্গী ছিলেন ল্যাস শোয়েনে ও ডনি ফন ডে বিক। ডে বিক সামনে খেলতেন, দুই রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে শোয়েনের সঙ্গী ছিলেন ডি ইয়ং।

শোয়েনের অফুরন্ত প্রাণশক্তি, ট্যাকল ও বল কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা নিশ্চিত করত ডি ইয়ংয়ের মতো বল পায়ে দক্ষ খেলোয়াড় যেন পেছন থেকে বল নিয়ে আক্রমণ রচনা করতে পারেন। আর আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে খেলা ডে বিকের কাজ ছিল সময়–সুযোগমতো ডি-বক্সে ঢুকে গিয়ে গোল করে আসা।

কিন্তু বার্সার এই ডি ইয়ং যেন আরও পরিণত, আরও দুর্দান্ত। প্রথমে ডি ইয়ংয়ের কাছ থেকে সম্পূর্ণ পারফরম্যান্স পাওয়ার লক্ষ্যে কোমান দলকে ৪-২-৩-১ ছকে খেলানো শুরু করলেও পরে দেখা গেল, ফর্মে তার ছাপ পড়ছে সামান্যই। এই কৌশলেই রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে এল ক্লাসিকো হেরেছিল তাঁরা।

এরপরেই ৩-৪-৩ ছক ঘুরে কোমানের ৪-৩-৩–এ থিতু হওয়া। যে ছকে বার্সার ডি ইয়ংয়ের ভূমিকা একই সঙ্গে আয়াক্সের ডি ইয়ং ও ফন ডে বিকের। ডি ইয়ং এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সামনে যেতে চান, ডি-বক্সে হুটহাট উঠে গিয়ে গোল করে আসতে চান। দলের প্রয়োজনে নিজেকে বদলেছেন এই ডাচ মিডফিল্ডার, যার সুফল পাচ্ছে বার্সা।

আক্রমণভাগে মূল স্ট্রাইকার হিসেবে লিওনেল মেসির দুই পাশে দুই উইঙ্গার হিসেবে খেলবেন দুই ফরাসি আঁতোয়ান গ্রিজমান ও উসমান দেম্বেলে। চোটের কারণে কুতিনিও, আরাউহো, আনসু ফাতি, সার্জি রবের্তোকে একেবারেই পাচ্ছেন না কোমান। মার্টিন ব্রাথওয়াইটকে পাওয়ারও তেমন সম্ভাবনা নেই।

বার্সেলোনার সম্ভাব্য একাদশ (৪-৩-৩) : টের স্টেগেন ; দেস্ত, পিকে, লংলে, আলবা ; বুসকেতস, ডি ইয়ং, পেদ্রি ; দেম্বেলে, মেসি, গ্রিজমান।

পিএসজি

নেইমার নেই, নেই আনহেল দি মারিয়াও। আক্রমণভাগের দুই বিশ্বস্ত খেলোয়াড়কে না পেয়ে পিএসজির নতুন কোচ মরিসিও পচেত্তিনো কীভাবে দলকে বার্সার জন্য প্রস্তুত করেন, এই ম্যাচের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় এটাই।

নিজের পছন্দের ৪-২-৩-১ ছক থেকে বেরিয়ে এসে দলের বৃহত্তর স্বার্থে কোমান যেখানে বার্সেলোনাকে ৪-৩-৩ ছকে খেলানো শুরু করেছেন, পচেত্তিনো ওদিকে নেইমার ও দি মারিয়াকে না পাওয়ার কারণে হয়তো পিএসজির পছন্দের ৪-৩-৩ ছক থেকে বেরিয়ে এসে ৪-২-৩-১ ছকেও খেলাতে পারেন দলকে।

নিসের বিপক্ষে ম্যাচটার কথাই ভেবে দেখা যাক। নেইমার চোটে পড়ার পর ওই এক ম্যাচেই খেলেছে পিএসজি। সে ম্যাচে ৪-৩-৩ ছক থেকে সরে এসে ৪-২-৩-১ ছকে দলকে খেলিয়েছেন পচেত্তিনো। এ ম্যাচেও ঠিক তেমন কিছু দেখা যেতে পারে।

গোলপোস্টের নিচে যথারীতি কেইলর নাভাস। সাবেক কোচ টমাস টুখেলের অধীনে পুরোদস্তুর রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার বনে যাওয়া ব্রাজিলিয়ান সেন্টারব্যাক মার্কিনিওস পচেত্তিনোর অধীনে ফিরে পেয়েছেন নিজের আগের জায়গা, অবশ্য এর পেছনে থিয়াগো সিলভার ক্লাব ছাড়ার ভূমিকাও আছে।

মার্কিনিওসের সঙ্গে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে এ ম্যাচে থাকবেন ফরাসি ডিফেন্ডার প্রেসনেল কিমপেম্বে। রোমা থেকে এই মৌসুমে ধারে পিএসজিতে যাওয়া ইতালিয়ান তারকা আলেসসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জি খেলবেন রক্ষণভাগের ডানে, লেভিন কুরজাওয়া খেলবেন বাঁয়ে।

৪-২-৩-১ ছকে দুই মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে পারেন আর্জেন্টাইন লিয়ান্দ্রো পারেদেস ও সেনেগালের ইদ্রিসা গেয়ে। নেইমার-দি মারিয়ার মতো দুজন লাতিন আমেরিকান না থাকলেও, পারেদেসের মতো আরেক লাতিন আমেরিকান সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে থেকে খেলার বাঁক বদলে দিতে পারেন।

পাশে থাকা ইদ্রিসা গেয়ে যেহেতু ট্যাকল বা বল কেড়ে নেওয়া, দৌড়াদৌড়ি করায় পটু, ক্যারিয়ারের শুরুতে বল পায়ে আক্রমণ রচনা করার ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখানো পারেদেসের ভূমিকা হতে পারে পেছন থেকে ওপরে থাকা এমবাপ্পেদের দিকে নিখুঁত বল পাঠানো।

যে কাজটা নিসের বিপক্ষে ম্যাচটায় বেশ ভালোভাবেই করেছেন এই আর্জেন্টাইন তারকা। গত চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে লাইপজিগের বিরুদ্ধে পারেদেস ঠিক এভাবেই খেলেছিলেন। পিএসজি সমর্থকদের আশা থাকবে, সেই পারেদেসের ঝলক আরেকবার দেখার।

আর পারেদেসকে পেছনে রেখে একটু সামনে খেলতে পারেন দলে ফেরা ইতালিয়ান মিডফিল্ডার মার্কো ভেরাত্তি। চোটের কারণে নিসের ম্যাচটা না খেলতে পারা ভেরাত্তি এই ম্যাচ দিয়েই ফিরছেন, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। বাঁ উইংয়ে এমবাপ্পেকে রেখে ডানে হয়তো মইস কিন খেলতে পারেন। সবার ওপরে একক স্ট্রাইকার হিসেবে মাউরো ইকার্দি।

অবশ্য স্ট্রাইকার হিসেবে ইকার্দির চেয়ে কিনের সঙ্গে দলের রসায়ন তুলনামূলক ভালো বলে কিনকে একক স্ট্রাইকার হিসেবে খেলিয়ে ডানে স্প্যানিশ উইঙ্গার পাবলো সারাবিয়াকেও খেলাতে পারেন পচেত্তিনো। নেইমার ও দি মারিয়া ছাড়াও এই ম্যাচে পিএসজি পাচ্ছে না রাইটব্যাক কলিন দাগবা, লেফটব্যাক হুয়ান বেরনাতের মতো তারকাদের।

পিএসজির সম্ভাব্য একাদশ (৪-২-৩-১): নাভাস; ফ্লোরেঞ্জি, মার্কিনিওস, কিমপেম্বে, কুরজাওয়া; পারেদেস, গেয়ে; কিন, ভেরাত্তি, এমবাপ্পে; ইকার্দি

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password