মধ্যরাতে কান্নার আওয়াজ পেলেও বাঁচানো যায়নি ২ বোনকে

মধ্যরাতে কান্নার আওয়াজ পেলেও বাঁচানো যায়নি ২ বোনকে
MostPlay

রাত তখন ১টা। মেহজাবিন আলভীদের ফ্ল্যাট থেকে ওদের দু’বোনের কান্নার আওয়াজ। মেহজাবিন আলভীর বয়স ১১ আর তার ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাতের বয়স সাত বছর। দু’বোনের চিৎকার শুনে পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা এসে কলিং বেল বাজালেও দরজা খোলেননি শিশু দু’টির মা আখতারুন্নেসা পপি। তারপরের ঘটনা খুবই নির্মম ও নৃশংস। গত শুক্রবার মধ্যরাতে রাজধানীর দক্ষিণ গোড়ানে মোল্লা ভবনের ৪/ডি ফ্ল্যাটে দুই শিশুকে হত্যার পর মা চেষ্টা করলেন আত্মহত্যার। আফসোস করে প্রতিবেশীরা বলছে- যদি কোনো কারণে ওই রাতে বুঝা যেত ওই ঘরে মায়ের নৃশংসতা চলছে, তাহলে দরজা ভেঙে হলেও শিশু দুটোকে বাঁচানো যেত।
এ ঘটনায় শিশুদের বাবা মোজাম্মেল হক বিপ্লব বাদি হয়ে গত শনিবার রাতে খিলগাঁও থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে মা আখতারুন্নেসা পপিকে।
খিলগাঁও থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, আলভী ও জান্নাত হত্যার ঘটনায় শিশুদের বাবা বাদি হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার একমাত্র আসামি দুই শিশুর মা পপিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে আদালতে পাঠানো হবে। এ ঘটনায় হত্যার অভিযোগের পাশাপাশি আত্মহত্যার চেষ্টার বিষয়েও অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
ওই ভবনের ৪/বি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা পারুল বেগম সাংবাদিকদের বলেন, শুক্রবার রাত ১টার দিকে শিশুদের আর্তনাদ শুনে একপর্যায়ে বাসা থেকে বের হয়ে ভাবীর দরজার কলিং বেল বাজাই। কয়েকবার বাজানোর পরও দরজা না খুললে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকি। এ সময় ভেতর থেকে পপি ভাবি জানতে চান, কে? তখন আমি বলি, ভাবী বাসায় কী হয়েছে, শিশুরা এভাবে কান্না করছে কেন? তখন দরজা না খুলেই ভেতর থেকে তিনি বলেন, এমনিতেই কান্না করছে। কোনো সমস্যা নেই, আপনি ঘুমান। কিছুক্ষণ পর আর কান্নার শব্দ শুনতে পাইনি। এরপর শনিবার সকালে পপির বাবার চিৎকারে ঘুম ভেঙে দরজা খুলে জানতে পারি, শিশু দুটিকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। আগুনে দগ্ধ হয়েছেন পপি।
প্রতিবেশীরা বলেন, আগে কখনো ওই বাসায় এমন চিৎকার শোনা যায়নি। দীর্ঘদিন তারা এই ফ্ল্যাটে থাকলেও কারো সঙ্গে মিশত না। রাতে বাসায় কম থাকত।
গত শনিবার সকালে খবর পেয়ে পুলিশ ওই বাসা থেকে আলভী ও জান্নাতের গলাকাটা ও আগুনে পোড়া লাশ উদ্ধার করে। আর তাদের মাকে দগ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠায়। বিষয়টি জানাজানির পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এরপর ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। দুপুরে শিশুদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায় পুলিশ।
পুলিশ বলছে, স্বামীর সঙ্গে বিরোধের জেরে হতাশ হয়ে দুই শিশুকে হত্যার পর নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন মা। এর আগে লেখা একটি চিঠিতে দুই সন্তানকে হত্যার কথা স্বীকার করেন পপি। ওই চিঠিতে তিনি (পপি) এ ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে তার স্বামীকেই দায়ী করেছেন।
ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন দগ্ধ আখতারুন্নেসা পপি বলেন, শুক্রবার রাতে ঘুমন্ত দুই শিশু জান্নাত ও আলভীকে হত্যার পরিকল্পনা করি। প্রথমে আগুনে পুড়িয়ে ও পরে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করি।
মা হয়ে কেন এমন নির্মম হত্যার ঘটনা ঘটালেন জানতে চাইলে পপি বলেন, সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারছিলাম না। সংসার চালানো যাচ্ছিল না। স্বামী মাসে সংসার খরচ দিত মাত্র এক হাজার ১০০ টাকা। ওই টাকায় কিছুই করা যাচ্ছিল না। এ নিয়ে হতাশা এবং বেঁচে থাকার নিরাশা থেকেই দুই সন্তানকে খুন ও নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে জানান তিনি।
সংসারে অভাবের কারণ স্বামীর পরকীয়া উল্লেখ করে পপি বলেন, মুন্সীগঞ্জে তন্নী আক্তার নামের এক মেয়ের সঙ্গে তার স্বামীর দীর্ঘ দিন ধরে মন দেয়া-নেয়া চলছে। এ ঘটনা জানাজানি হলে সে আমার সংসারের নিয়মিত খরচ দিত না। মেয়েদের পড়াশোনা করার জন্য ঠিকমতো টাকা দিত না। বরং আমাকে নানাভাবে নির্যাতন করত। সে মাসের মধ্যে দু’এক দিন ঢাকায় থাকত আর বাকি দিনগুলো মুন্সীগঞ্জে ওই মেয়ের সাথে সময় পার করত। তাই জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password