এ বার বুঝুন, পৃথিবীটা মানুষের একার নয়

এ বার বুঝুন, পৃথিবীটা মানুষের একার নয়
MostPlay

সেই চরক, সুশ্রুতের ভারতীয় আয়ুর্বেদের সময় থেকেই রোগজীবাণুর সঙ্গে মোকাবিলা করে আসা বুদ্ধিমান মানুষ আজ আবার নতুন করে ‘আইসোলেশন’ আর ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’-এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে, বাস্তব জীবনে নিজেকে ‘কোয়রেন্টাইন’ রাখতে শিখছে। অথচ এর চল রয়েছে পশুপাখিদের মধ্যেও। বাইরে থেকে আসা কোনও পশুপাখিকে নিজেদের সমাজভুক্ত হয়ে ওঠার আগে কিছু দিন আলাদাই থাকতে হয়। এমনকি এও দেখা গিয়েছে, কোনও পাখির ছানা মানুষের সংস্পর্শে এসে পড়লে তাকে ব্রাত্যই থাকতে হয় পরিবারের থেকে। 

‘ভাইরাস’ বিষের করাল গ্রাস মানবজাতি এর আগেও চাক্ষুস করেছে। কলেরা, গুটিবসন্ত, প্লেগ হয়ে সার্স, ইবোলা বা আজকের কোভিড ১৯ বা করোনা। উদ্বর্তনের লড়াইয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ঝালিয়ে নেওয়ার সময় এসে গিয়েছে মানবসভ্যতার সামনে। প্রত্যাঘাত করার মতো অস্ত্র এখনও মানুষের হাতে নেই, তাই ‘লকডাউন’ই এখন একমাত্র ভরসা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীবকুলের। ‘বার্ড ফ্লু’ বা ‘ফুট অ্যান্ড মাউথ’-এর মতো ভাইরাল রোগের শিকার এর আগে পশুপাখিরাও হয়েছে কিন্তু বর্তমানের এই একশো পঁচিশ ন্যানোমিটারের কোভিড ১৯ শিকার হিসেবে বেছে নিয়েছে শুধু মানুষ নামক বুদ্ধিমান প্রাণীটিকেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত সেটাই আমরা জানি। অন্য পশুপাখি তাই বহাল তবিয়তেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আর  মানুষ হয়ে পড়েছে ‘খাঁচাবন্দি’। ছবিটা তাই পাল্টে গিয়েছে অনেকটাই। 

এমনিতেই এখন চড়াই, শালিক বা দোয়েলদের ছানাপোনা লালন পালন করার সময়। তার উপর লকডাউনের কারণে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমেছে, কমেছে হিমবাহের বরফ গলনও। অন্য দিকে বেড়েছে দৃশ্যমানতা। মানুষের শ্বাসযন্ত্রকে বিকল করার খেলায় নেমেছে করোনা আর অন্য দিকে সেই সুযোগে ধরিত্রী আবার যেন প্রাণ ভরে একটু শ্বাস নিতে পারছে। খানিকটা অসময়েই যেন আবার ফিরে আসছে পরিযায়ী পক্ষীকুল, পুকুরের জলেও খেলে বেড়াচ্ছে লেসার হুইসলিং ডাকের দল। কোকিল আর বেনেবৌদের কলতানে চারিদিক এখন মুখরিত। সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপেঁচাদের চিৎকারে এখন কান পাতা দায় আর মাঝরাতে শিস দিয়ে গান গেয়ে ডেকে উঠছে একলা দোয়েল। 

ভাবতে অবাক লাগছে, এত সঙ্কট আর করোনা আতঙ্কের আবহে মুক্ত মানুষজনের জন্য মাস্ক বানাচ্ছেন জেলখানার কয়েদিরা আর সেগুলো বিতরণ করে বেড়াচ্ছেন সমাজে অবহেলিত বৃহন্নলাদের দল। এই মৃত্যু আর ভয়ের একটা পরিবেশে একদিকে পুলিশ মানুষকে সচেতন করতে  রাস্তায় গান গাইছেন আর স্মৃতির ধুলো ঝেড়ে অলস দুপুরে হাইজিন মেনে, ছাপোষা মধ্যবিত্ত, ব্যালকনিতে বসে ফিঙে আর হাঁড়িচাচার হরবোলা শুনছে। 

‘‘একটা ক্ষীণ ভরসা ছিলো এই সেদিন পর্যন্ত, যেভাবে এই সব ঘটে, এই সব ঘটে যায় সেই ভাবে একদিন সব ঠিকঠাক হবে। আমার কিছু করণীয় নেই, শুধু বসে থাকার অপেক্ষা’’ ধোঁয়াহীন বাতাসে বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে নিতে তারাপদ রায়ের ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’-র প্রতিটা লাইন ভীষণই প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে আজ। মারণ ক্ষমতার তুলনায় কোথায় আমরা আর কোথায় এই দু’দিনের ‘ছোকরা’ করোনা। মাত্র কয়েকশো বছরে আমরা দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দিয়েছি কয়েক লক্ষ প্রজাতির জীবকুলকে। ১৫৯৮ থেকে ১৬৬২ মাত্র চৌষট্টিটা বছরে আমরা নিরীহ ‘ডোডো’কে পাঠিয়ে দিয়েছি গল্পগাথায়, আমাদের কৃতকর্মেই হারিয়ে যেতে বসেছে ‘ঝাড়ুদার’ শকুনের দল। অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে আমরাই অন্য জীবের রসদ আর বাসস্থান নিয়েছি ছিনিয়ে। শুধু খাদ্যের জন্যও নয়, আমাদের শৌখিনতা আর উদ্দামতার বলি হয়েছে কত নিরীহ প্রাণী। অদৃষ্টের পরিহাস সত্যিই ভারী অদ্ভুত। ঈশ্বরের সম্পদ মানুষের সেবায় লাগানোর প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছে। বিশ্বজোড়া আর্থিক ক্ষতির মাঝে চিকিৎসা বিজ্ঞান অপ্রতুলতার সাগরে খাবি খাচ্ছে আর সেরাটোনিনের অভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে প্রাণিশ্রেষ্ঠ মানবজাতি। ১৯১২তে টাইটানিক যখন ডুবে যায়, তখনও যাত্রীসংখ্যার নিরিখে লাইফবোটের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। পৃথিবীতে মানবজাতির এই ঘোর সঙ্কটময় মুহূর্তেও আমাদের তাই ভাল থাকা শিখতে হবে নতুন করে। মৃত্যু ভয়ে নয়, ভালবাসার বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, পৃথিবীতে টিকে থাকতে গেলে। ভুললে চলবে না, দূষণহীন পরিষ্কার আকাশে সমানে চক্কর কাটছে চিল আর বাজের দল। ১৫৬৪ থেকে ২০১৯-২০ মধ্যিখানে অনেকটা সময়ের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়েছে টেমস আর গঙ্গা দিয়ে। বাংলাও ঠিক এই মুহূর্তে সম্ভবত লন্ডন হতে চায় না আর। এ বারে মানুষের সঙ্গে মৃত্যুমিছিলে সঙ্গী কেউ নেই। 

আসুন সকলে মিলে প্রকৃতি মায়ের কাছে নতজানু হই। একটু সময় আরো চাই, আরও একটু সময়। হতাশ না হয়ে তাই প্রহর গুনুন। আজ না হলে কাল বিজ্ঞান সফল হবেই। এই সময়ের মধ্যে মাছরাঙার ডাক চিনুন, পাখিদের জল খাওয়ান আর হ্যাঁ, পারলে একমুঠো ভাত কম খেয়ে বাড়ির সামনের কুকুরটাকেও দুমুঠো খেতে দিন। ভুলে যাবেন না, সেও কিন্তু আপনার সহযাত্রী। পৃথিবীটা শুধু আপনার আর আমার নয়।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password